Mahfuzur Rahman Manik
ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি: শিক্ষা সংকোচনের বিপজ্জনক পথ
নভেম্বর 1, 2025

অংশীজনের মতামত চেয়ে প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির খসড়া অধ্যাদেশ সম্প্রতি প্রকাশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ অধ্যাদেশে কী থাকবে, তা আগেই কিছুটা অনুমিত ছিল। সাত কলেজ সংকটের সমাধান হিসেবে প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি গঠিত হলেও খসড়া অধ্যাদেশে এর যে রূপরেখা দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, সমস্যা আরও ঘনীভূত করার আয়োজন চলছে। সে জন্য খসড়া অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে অবশ্যই কিছু বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। খসড়া অধ্যাদেশের ওপর অংশীজনের যে মতামত আহ্বান করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এ লেখা তারও অংশ।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’কে যে কাঠামোতে তৈরি করতে চাচ্ছে, সংকটটা সেখানেই। খসড়া অধ্যাদেশে সাতটি কলেজকে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই রূপ দেওয়ার চিন্তা চলছে, যেখানে সাতটি কলেজ তার আলাদা ক্যাম্পাস হিসেবে পরিগণিত হবে। তার মানে, এই অবকাঠামোতে আর সাত কলেজের অস্তিত্ব থাকছে না। সে জন্য খসড়া অধ্যাদেশ প্রকাশের আগ থেকেই ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের কলেজের স্বাতন্ত্র্য ও ঐতিহ্য রক্ষায় আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তারা ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির 'অধিভুক্ত' হিসেবে নিজেদের দেখতে চাইছেন। সাত কলেজের শিক্ষকদের দাবিও অনুরূপ। 

ঢাকার সাতটি ঐতিহ্যবাহী কলেজ (ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ এবং সরকারি তিতুমীর কলেজ) এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই ছিল। পরে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে দেশের সব কলেজের সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। এরপর ২০১৭ সালে কোনো ধরনের সমীক্ষা ও প্রস্তুতি ছাড়াই হুট করে সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেওয়া হয়। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হওয়ার পর সাত কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। শিক্ষার্থীরা ভোগান্তি ও সেশনজটে পড়েন। শেষ পর্যন্ত আন্দোলন করে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যান। তার সমাধান হিসেবেই তৈরি হচ্ছে প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি।

আগে যেখানে কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল, সেখানে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির কেন নতুন কাঠামো? একে আলাদা প্রতিষ্ঠান করে তার অধীনে এখনও সাত কলেজকে দেওয়ার সুযোগ আছে। অন্যথায় এটি গ্রাম থেকে আসা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত করে ফেলবে। অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সামর্থ্য সবার নেই। 
ভবিষ্যতে কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক উঠে গেলে ঢাকা কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ঐতিহ্যও হারাবে। ঢাকা মহানগরের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা সরকারি কলেজে পড়া থেকে বঞ্চিত হবেন। ইডেন কলেজ ও বদরুন্নেসা কলেজ নারীদের পড়াশোনার স্বাতন্ত্র্য হারাবে এবং এতে নারী শিক্ষার পথও সংকুচিত করবে। 

এর বিরুদ্ধে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা খসড়া অধ্যাদেশ প্রত্যাখ্যান করে কেবল আন্দোলনই করছেন না, বিকল্প মডেলও দেখিয়েছেন। তারা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি মডেল অনুসরণের দাবি করেছেন, যেখানে সব কলেজের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকবে এবং প্রতিটি বিভাগে অন্তত ১৬ জন শিক্ষক ও গবেষণা বাজেট থাকবে। এটি অনেকটা কলেজিয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। যেখানে কলেজগুলো স্বাতন্ত্র্য ও কাঠামো বজায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকে। প্রতিবেশী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও এমন একটি কলেজিয়েট ইউনিভার্সিটি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও অনুরূপ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই এ মডেল আছে। ইউজিসি সেই মডেল অনুসরণ করতে পারে। 

কলেজিয়েট মডেলের বদলে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির প্রস্তুাবিত কাঠামো শিক্ষা সংকোচনের বিপজ্জনক পথ বেছে নিয়েছে। শিক্ষার সুযোগ যেখানে বাড়ানো জরুরি, সেখানে সংকোচন ঘটাবে ব্যাপকভাবে। যেমন প্রস্তাবিত ইউনিভার্সিটির স্নাতক ভর্তি কার্যক্রমে এবার অর্ধেকের বেশি সংখ্যক আসন কমেছে। এ কাঠামো বাস্তবায়িত হলে সাত কলেজের ঐতিহ্য, স্বাতন্ত্র্য বলে কিছু থাকবে না। উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক বিদ্যায়তন ঢাকা কলেজ ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও জ্যেষ্ঠ। ইডেন কলেজ ১৮৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত। কবি নজরুল সরকারি কলেজ ১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। তিতুমীর কলেজসহ সাতটি কলেজের ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য অগ্রাহ্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ড ক্যাম্পাসে পরিণত করার দুর্বুদ্ধি কার মাথা থেকে বের হয়েছে!
যানজটের শহর ঢাকায় একেক প্রান্তে একেক খণ্ড ক্যাম্পাস বানাতে চায় কোন দিগ্‌গজ! 

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির প্রস্তাবিত কাঠামোতে শিক্ষা ক্যাডারও সংকটে পড়বে। এই ক্যাডার এমনিতেই নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার। নতুন আয়োজনে তাদের পদায়নের সুযোগ আরও সংকুচিত হবে এবং মেধাবীরা উৎসাহ হারাবে। কলেজগুলোর বর্তমান শিক্ষকদের পদায়নও কম ভোগান্তির কারণ হবে না।

সব মিলিয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির খসড়া অধ্যাদেশ পরিবর্তন করা জরুরি। অংশীজনের মতামত না নিয়েই ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোন যুক্তিতে সাত কলেজের অবকাঠামো ভেঙে একটি ইউনিভার্সিটি করার দিকে এগোচ্ছে? যেহেতু শিক্ষা মন্ত্রণালয় অধ্যাদেশকে খসড়া বলছে, সেহেতু বাস্তবতার আলোকে পুনর্বিবেচনাই শিক্ষার স্বার্থে মঙ্গলজনক হবে। 

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে ভূমিকা পালন করছে, সেভাবে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিকে গড়ে তুলে শিক্ষার মানোন্নয়ন ও গবেষণায় প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে অধিভুক্ত কলেজ হিসেবে সাত কলেজের স্বাতন্ত্র্য ও ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান দেখানো প্রয়োজন। অফলাইন-অনলাইনের যে হাইব্রিড মডেলের কথা বলা হচ্ছে, তা স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত করার মাধ্যমেও সম্ভব। শিক্ষা সংকোচনের পথ থেকে বেরিয়ে আসুক ইউজিসি। 

সমকালে প্রকাশ: ১ অক্টোবর ২০২৫-ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি: শিক্ষা সংকোচনের বিপজ্জনক পথ

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।