
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের হাওয়া বইছে, তখন একই সঙ্গে নির্বাচনী পরিবেশ বিঘ্নের ঘটনাও ঘটছে। হঠাৎ শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ঘটনাগুলো ভিন্ন হলেও অনাকাঙ্ক্ষিত এবং সেগুলোর দ্রুত সমাধান না হলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। একটি প্যানেলের জিএস প্রার্থীর প্রার্থিতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে করা এক রিটকে কেন্দ্র করে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে নাটকীয়তা; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয়দের মধ্যে; বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বহিরাগতদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় অচলাবস্থা এখনও কাটেনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্দোলন চলছে রাকসু নির্বাচনে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে।
দেশের চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের যে তপশিল ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, সবার আগে ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনের ভোট হবে ১১ সেপ্টেম্বর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন হবে ২৫ সেপ্টেম্বর এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ১২ অক্টোবর। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি উঠছে এবং আশা করা যায়, চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারাবাহিকতায় সেগুলোতেও শিগগির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনের আগে ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হওয়া নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। সে জন্যই এসব নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হওয়া জরুরি এবং এখানে নির্বাচনী পরিবেশ বজায় রাখার দায় সবার। রোববার বিকেলে আদালত থেকে যখন ডাকসু নির্বাচন স্থগিত হওয়ার খবর আসে, অনেকে সামাজিক মাধ্যমে তাদের আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তাহলে কি জাতীয় নির্বাচন একই ধারায় যাচ্ছে? অবশ্য কিছুক্ষণ পরই চেম্বার আদালতে সেই আদেশ স্থগিত হলে জনমনে স্বস্তি আসে।
চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ ফিরে আসে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এ নির্বাচন হয়নি। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। এর বাইরে সাড়ে তিন দশক ধরে অনুপস্থিত এসব নির্বাচন নতুন করে ধারাবাহিকতার আশা জাগাচ্ছে। চব্বিশের অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা, যেখানে সব দলের সহাবস্থান থাকবে। প্রত্যেকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে এবং ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির নামে বিরোধী মত নিপীড়নের পথ বন্ধ হবে। সে প্রত্যাশা এখনও আছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে তা পূরণ হওয়ার পথ প্রশস্ত হবে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পাশাপাশি প্রার্থীদের দায়ও কম নয়। এক সপ্তাহের মধ্যেই ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে। দলবদ্ধ প্যানেলে ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সবাই ভোটের প্রচারণায় নেমেছেন। এর মধ্যে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, যা প্রত্যাশিত নয়। ছাত্রদের প্রতিনিধি হওয়ার আশায় যারা লড়ছেন, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু তা যেন দূষণের কারণ না হয়। ইতোমধ্যে প্যানেলগুলো তাদের ইশতেহার ঘোষণা করেছে। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই অনেক প্রত্যাশিত প্রতিশ্রুতি এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখা, ছাত্রীদের নিরাপত্তা, আবাসন সংকট নিরসন, গবেষণায় জোর দেওয়া, পরিবহন সমস্যার সমাধানসহ নানা বিষয় যেমন এসেছে, তেমনি গেস্টরুম, গণরুম ও র্যাগিং সংস্কৃতি বন্ধের প্রতিশ্রুতিও এসেছে। ডিজিটালাইজেশন, স্বাস্থ্য বীমা, পোশাকের স্বাধীনতা, গ্রিন ক্যাম্পাস গঠন– অনেক অভিনব বিষয় ইশতেহারে ঠাঁই পেয়েছে। এর মাধ্যমে প্যানেলগুলো যে ইতিবাচক বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তা তাদের কর্ম ও আচরণে ফুটে উঠবে বলে বিশ্বাস।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যা অনুযায়ী ইশতেহার ঘোষণা করবেন। কিন্তু ইশতেহারে কথা কিতাবে থাকার চেয়ে গোয়ালে থাকা জরুরি। মনে রাখা দরকার, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের চেয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেবল শিক্ষাঙ্গনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর আগে যেমন ছাত্র সংসদ থেকেই জাতীয় নেতৃত্ব উঠে এসেছে, এবারও হয়তো তার ব্যতিক্রম হবে না। বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এটা প্রমাণিত। এ আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই প্রার্থী হয়েছেন। সে সময় তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছিলেন, এখন তারা ভিন্ন ভিন্ন প্যানেলে বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন। এ কারণেই আমরা ক্যাম্পাসে ভিন্নমতের সহাবস্থান দেখতে পাই।
ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। ফলে এটা সরকারেরও দায়িত্ব, যাতে ক্যাম্পাসের পরিবেশ ঠিক থাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা ঠিক না থাকলে তার প্রভাব ক্যাম্পাসগুলোর ওপর পড়তে বাধ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠছে। এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘাতে তাদের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছে। ক্যাম্পাসের ভেতরে এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা কঠিন। এটা মনে রাখা দরকার, বিগত সরকারের সময়ে ডাকসু ছাড়া কোনো ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ঘোষিত সব ছাত্র সংসদ নির্বাচন করে অন্তর্বর্তী সরকার উদাহরণ তৈরি করে যেতে পারে, যা আগামীর জন্যও অনুসরণীয় হবে।
ডাকসু, জাকসু, রাকসু, চাকসুসহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সব প্যানেল, দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ থাকবে– এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই নির্বাচনী পরিবেশ রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায় অনেক বেশি। এ নির্বাচনে কেউ যাতে কোনোভাবে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সে জন্য সজাগ থাকা এবং আগেই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের পছন্দমতো প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতেই হবে। এর মাধ্যমে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য আগামী নির্বাচনেও তার ইতিবাচক প্রভাব আমরা দেখব।
সমকালে প্রকাশ: ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫: ছাত্র সংসদ নির্বাচন এবং কর্তৃপক্ষের দায়