Mahfuzur Rahman Manik
গাজায় সাংবাদিক হত্যা এবং ইসরায়েলের ‘লাইসেন্স টু কিল’
অক্টোবর 7, 2025

এতদিন গাজার মানুষের ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসনের সংবাদ পাঠানো আলজাজিরার সাংবাদিক আনাস আল-শরীফ নিজেই খবর হয়ে গেলেন। ইসরায়েল রোববার তাঁকেসহ সংবাদমাধ্যমটির আরও চার সাংবাদিককে নিশানা ও হত্যা করেছে। এমন হত্যাকাণ্ডে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠেছে। বস্তুত ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েল গাজা ভূখণ্ডে যেভাবে গণহত্যা চালাচ্ছে, তাতে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ হয়েছে। খোদ ইসরায়েলেও বিক্ষোভ হচ্ছে; কিন্তু আগ্রাসন বন্ধ হয়নি। ৬৩ হাজারের অধিক ফিলস্তিনি শহীদ হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৮ হাজারের বেশি শিশু। আলজাজিরার সাংবাদিক আনাস ও তাঁর সহকর্মীরা সর্বসাম্প্রতিক নিশানা হলেও সর্বশেষ নয়।

আনাস আল-শরীফ এক্স হ্যান্ডলে সর্বশেষ যে বার্তা দিয়ে গেছেন, তা হৃদয়বিদারক। তিনি লিখেছেন– ‘আল্লাহ জানেন, আমি আমার জনগণের পাশে দাঁড়াতে এবং তাদের কণ্ঠস্বর হতে সর্বশক্তি ও প্রচেষ্টা নিয়োগ করেছি। আমার আশা ছিল, আল্লাহ আমাকে জীবন দীর্ঘ করবেন, যাতে আমি আমার পরিবার ও প্রিয়জনদের নিয়ে দখলকৃত আসকালান (আল-মাজদাল) শহরে ফিরে যেতে পারি। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছাই প্রথম এবং তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আমি সত্যকে গোপন না করে তা অবিকৃতভাবে তুলে ধরতে কখনও দ্বিধা করিনি। আল্লাহ যেন সাক্ষী থাকেন সেসব মানুষের বিরুদ্ধে, যারা নীরব থেকেছে; যারা আমাদের হত্যা মেনে নিয়েছে।’
হামলার শিকার হওয়ার কিছুক্ষণ আগেও আনাস গাজা নগরীর পূর্ব ও দক্ষিণ অংশে তীব্র বোমাবর্ষণের খবর দিয়েছিলেন। তাঁর শেষ ভিডিওতে আমরা ইসরায়েলের ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার তীব্র বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। আনাস আলজাজিরার আরবি সংস্করণে কাজ করতেন; গাজার আল-শিফা হাসপাতালের প্রধান গেটের বাইরে সাংবাদিকদের তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন। সেখানে তাঁর সহকর্মী মোহাম্মদ কুরেইকেহ, ইব্রাহিম জাহের, মোহাম্মদ নুফাল, মুয়ামেন আলিওয়াসহ পাঁচজন শহীদ হন।

বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে সম্ভবত আলজাজিরাই গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। দেড় বছর ধরে তাদের ওয়েবসাইটে শীর্ষ খবর হিসেবে ফিলিস্তিন পরিস্থিতিই রয়ে গেছে। স্বভাবতই ইসরায়েল সংবাদমাধ্যমটিকে নিশানা করেছে। ইতোমধ্যে ইসরায়েলি হামলায় আলজাজিরার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংবাদকর্মী হত্যার শিকার হয়েছেন। গত বছরের এপ্রিলে আইন করে ইসরায়েল থেকে আলজাজিরার সম্প্রচার বন্ধ করে দেশটি। এর পর সেপ্টেম্বরে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের রামাল্লা শহরে আলজাজিরা টিভির কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে কার্যালয় বন্ধের নির্দেশ দেয়। এখন একসঙ্গে পাঁচ কর্মীর হত্যাকাণ্ড সংবাদমাধ্যমটির বড় ক্ষতি ও বেদনার বিষয় বটে। বিশেষত আলজাজিরার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক মোহাম্মদ মোওয়াদ বিবিসিকে বলেছেন, গাজার ঘটনাকে বিশ্বকে জানানোর জন্য ‘একমাত্র কণ্ঠস্বর’ ছিলেন আনাস আল-শরীফ। ২৮ বছরের টগবগে তরুণ আনাস কীভাবে ইসরায়েলি গণহত্যার খবর প্রচার করতেন, তার কিছু ফুটেজও প্রচার করে আলজাজিরা।
ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে গাজা সাংবাদিকদের জন্যও ভয়ংকর। সেখানে কারও নিরাপত্তা নেই। আলজাজিরার হিসাবে ২০২৩-এর ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ২৭০ সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী নিহত হয়েছেন। সেখানে শিশুরাও গণহত্যার শিকার; হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রেহাই পায়নি। এমনকি চিকিৎসক ও মানবিক সহায়তাকর্মীরাও হত্যার শিকার হয়েছেন। বিশ্ব সম্প্রদায় কীভাবে এতদিন ধরে গণহত্যা চালাতে দিচ্ছে! আলজাজিরার সাংবাদিক আনাস আল-শরীফ এই নীরবতার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে গেছেন। জবাব আছে কি?

ইসরায়েলকে ‘লাইসেন্স টু কিল’ বা হত্যার অনুমতি ও সমর্থন যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব দিয়ে যাচ্ছে, তাতে লুকোচুরির কিছু নেই। অথচ এই পশ্চিমা বিশ্বই মানবাধিকারের কথা বলে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপারে সোচ্চার। রোববার ইসরায়েল যেভাবে নিশানা করে একসঙ্গে এত সাংবাদিককে হত্যা করল, তার পরও কি পশ্চিমা বিশ্ব এভাবে ইসরায়েলকে ‘ব্ল্যাংক চেক’ দিয়ে যাবে? 
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট-সিপিজে বলেছে, ইসরায়েল বার্তাবাহকদের হত্যা করছে। তারা পূর্ণাঙ্গ সংবাদ গ্রুপকে নিশ্চিহ্ন করেছে। সিপিজে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি বলেছে তা হলো, ‘আনাস আল-শরীফের মতো গাজার সবচেয়ে বিখ্যাত সাংবাদিককে যদি ইসরায়েল হত্যা করতে পারে, তবে তারা যে কাউকে হত্যা করতে পারবে। বিশ্বের উচিত গাজার ভেতর সাংবাদিকদের এমন ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড আমলে নেওয়া। পাশাপাশি ইসরায়েল পশ্চিম তীরে যেভাবে সাংবাদিকদের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করেছে, তাও উপেক্ষা করা চলবে না। সাংবাদিকদের এভাবে নিশানা করে পরকল্পিত হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ। এই গণহত্যা বন্ধ করতেই হবে।’

সংবাদকর্মী হিসেবে দেশে বা বিদেশে সাংবাদিকদের হত্যার খবর আমাদের বেদনাহত করে। আমরা আতঙ্কিত হই সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে। অকুতোভয় সাংবাদিকরা জীবনের মায়া না করে বিশ্বের কাছে বাস্তবতা তুলে ধরে। গাজার সাংবাদিকরাও জানে, তাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। তার পরও তারা নিরলস সম্প্রচার করে যাচ্ছে। আলজাজিরা এ ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকার কারণেই সংবাদমাধ্যমটি বেশি রোষানলের শিকার। হাসান আবু কামার নামে গাজার এক লেখক আলজাজিরায় প্রকাশিত নিবন্ধে লিখেছেন, আনাস তাঁর কণ্ঠ তুলে ধরেছেন; কিন্তু বিশ্ব তার দায়িত্ব পালন করেনি। সাংবাদিক আনাস আল-শরীফ ও তাঁর সহকর্মী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা। গাজা মুক্ত হলেই শুধু তাদের ত্যাগের খানিকটা মূল্যায়ন সম্ভব হবে।

সমকালে প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৫

ট্যাগঃ ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।