Mahfuzur Rahman Manik
ঝরে পড়া ফুলগুলোর জন্য শোক
আগস্ট 5, 2024

নারায়ণগঞ্জের ৬ বছরের শিশু রিয়ার বাবার স্থানে আমি নিজেকে আবিষ্কার করি; প্রায় একই বয়সী আমারও একটি কন্যাসন্তান আছে। ২০ জুলাই বাড়ির ছাদে খেলতে গিয়ে রিয়া ফিরে আসেনি। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! একটি গুলি এসে তার মাথায় লাগে। যে বয়সে মেয়েটি বুঝতে শেখেনি জীবন কী, সেই বয়সেই গুলিটি তার জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিল। গোলাগুলির শব্দ শুনে বাবা রিয়াকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু বাবার কোলও নিরাপদ থাকেনি। বাবা এ শোক সইবেন কীভাবে?

সোমবার প্রকাশিত সমকালের আলোচিত একটি প্রতিবেদন ছিল: ফুল হয়ে ফোটার আগেই ঝরল ওরা। সেখানে কেবল রিয়াই নয়, উঠে এসেছে আটটি শিশুর নির্মম প্রাণহানির গল্প। আহাদের বয়স মাত্র ৪ বছর। অঘটনের দিন ১৯ জুলাই মা-বাবার সঙ্গে বাসায়ই ছিল শিশুটি। যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় যেখানে তারা ভাড়া থাকে, সেখানে গোলাগুলির শব্দ শুনে সবার সঙ্গে আহাদও বারান্দায় গিয়েছিল। হঠাৎ আসা একটি বুলেটে লুটিয়ে পড়ে শিশুটি। হাসপাতালে নিয়েও আহাদকে ফেরানো যায়নি। গোলাগুলির শব্দ শিশুমনকে কৌতূহলী করেছিল। কিন্তু জীবনের যে সংগ্রামে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিল, তা কোনোভাবেই শিশুটির বোঝার কথা নয়। তবুও ঘাতক বুলেট তাকে বাঁচতে দিল না। গুলি চোখ দিয়ে ঢুকে মাথায় আটকে যায়। কত কষ্টই না হয়েছিল বাচ্চাটির!
সমকালের বিশ্লেষণে এসেছে, সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সংঘর্ষে ১৮ বছরের কম বয়সী অন্তত ৩৫ শিশু প্রাণ হারিয়েছে। বাড়িতে থেকেও শিশুরা রক্ষা পায়নি। জানালা বন্ধ করতে গিয়েছিল মিরপুরের ১১ বছরের শিশু সামির। টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়া প্রতিরোধ করতে গিয়ে তখনই গুলিবিদ্ধ হয় শিশুটি। ফুলের মতো শিশুদের প্রাণ এভাবেই ঝরে গেল! হোসাইন, মোবারক, তাহমিদ, ইফাত কিংবা নাঈমা কোনো অপরাধ করেনি। কাউকে মারার তো প্রশ্নই আসেনি। অথচ প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে প্রাণ গেছে এই শিশুদের। গুলিবিদ্ধ হয়েছে আরও অনেক শিশু-কিশোর, যারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

বুধবার ১৬ শিশুর মৃত্যুর তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে রিট হয়েছে। সমকালের প্রতিবেদনও রিট আবেদনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। শিশুদের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত করতে বিচার বিভাগীর তদন্তের পাশাপাশি প্রত্যেক শিশুর পরিবারকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয় সেখানে। মানুষের প্রাণের বিনিময়ে কোনো টাকার অংকই যথেষ্ট হতে পারে না। তার পরও এ উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য।
যেসব শিশু প্রাণ হারিয়েছে, তাদের পরিবারের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আছে। সন্তানহারা মা-বাবার কান্না কি এত সহজে থামে? মঙ্গলবার সমকালের একটি খবর বলছে, সন্তানশোকে খাবার নামে না গলায়। তিলে তিলে যে সন্তানকে বড় করে তুলেছেন মা-বাবা, সেই সন্তানের এমন করুণ মৃত্যুর শোক কি এক জীবনে শেষ হতে পারে? যাদের সন্তান গ্রেপ্তার হয়েছে কিংবা আহত হয়ে হাসপাতালে, তাদের বেদনা অনুধাবন করাও কঠিন নয়। এমন এক পরিস্থিতিতে আমরা বাস করছি, যাদের সন্তান ভালো আছে তারাও নিরাপদ বোধ করছে না। এক শিশু বাবাকে বলেছিল আম আনতে। সেই বাবা ফিরলেন গুলিবিদ্ধ লাশ হয়ে। মাত্র আড়াই মাস বয়সেই এতিম হয় এক শিশু; ঘাতকের বুলেট কেড়ে নিয়েছে তার মা সুমাইয়ার জীবন।

সরকার বলছে, তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে, আন্দোলনকারীদের হয়রানি করবে না। অথচ পুলিশ বাসায় বাসায় গিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করছে, যাদের অনেকের বয়স ১৮ হয়নি। যেভাবে মানুষের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করছে, তাও আতঙ্কিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এমনকি কোনো কোনো অভিভাবক তাঁর গ্রেপ্তার করা সন্তানকে সাত-আট দিন ধরে খুঁজে হয়রান। পুলিশের কাছে ধরনা দিয়েও পাচ্ছেন না।
এখন প্রশ্ন, যে নিরীহ শিশুরা অকালে ঝরে পড়ল, তাদের মা-বাবা, অভিভাবকদের দেওয়ার মতো জবাব কার কাছে আছে? ভিডিওতে দেখেছি, পুলিশ নিরস্ত্র আবু সাঈদের ওপর গুলি চালিয়েছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, বিল্ডিংয়ের কার্নিশে ঝুলে থাকা কিশোর, যে একটু বাঁচতে চেয়েছে, তার ওপরও গুলি চালানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন গুলিতে চোখ হারানোর শঙ্কায় আছেন। চোখে অস্ত্রোপচারের পরও তারা মুক্ত নন। গুলির অপব্যবহারে নিরীহ প্রাণ কীভাবে ঝরে যায়; কীভাবে অন্যেরা আক্রান্ত হয়; কীভাবে মানুষকে সন্তানহারা বানায়, তাও দেখা গেল। কিন্তু কী বিস্ময়, গুলিতে নিহত শিক্ষার্থীর তথ্য নেই পুলিশের মামলায়!

সংঘর্ষে পরিস্থিতি খারাপ হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরাসরি গুলি না করে কীভাবে ছত্রভঙ্গ করবে কিংবা আত্মরক্ষার্থে করণীয়সহ যাতে আশপাশের নিরীহ কেউ আক্রান্ত না হয়, সেই নির্দেশনাও নিশ্চয় দেওয়া হয়। সেগুলো কতটা মানা হয়েছে– সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এতটা বেপরোয়া না হলে অন্তত শিশুসহ নিরীহ প্রাণগুলো বাঁচত।
যে কোনো প্রাণহানি বেদনার; যে কোনো মৃত্যু আমাদের ব্যথিত করে; স্বজনের বিদায়ে আমরা কাতর হই কিন্তু ফুলের মতো শিশুর প্রাণহানি আমাদের পাথর বানিয়েছে। পুরো জাতি তাই শোক করছে। অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। শিশুরা আর ফিরে আসবে না। দুই শতাধিক মৃত মানুষ কাউকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কিন্তু তারা যে প্রশ্নগুলো রেখে গেছে, তার জবাব খুঁজতে হবে। আমাদের সমাজ, রাজনীতি, প্রশাসন সর্বত্র জঞ্জালে ভরপুর। সেগুলো সরাতে হবে। শিশুর নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্যই তা জরুরি। সুকান্ত যথার্থ বলেছেন– ‘চলে যাব– তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/ এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি–/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’

সমকালে প্রকাশ: ৩ জুলাই ২০২৪

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।