মাইকেল কুগেলম্যান
ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক
সরকার পরিবর্তনহীন রাজনৈতিক উত্তরণ
দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশে ২০২৪ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং খুব সম্ভবত ক্ষমতাসীন দলগুলোই ক্ষমতায় থাকবে। ভুটান অবশ্য এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। নভেম্বরে প্রথম রাউন্ডের ভোটে সেখানে ক্ষমতাসীন দল বাদ পড়েছে এবং অন্য দুটি দল ৯ জানুয়ারির রানঅফ তথা পরবর্তী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে। এর মধ্যে একটি দল ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ভুটানে ক্ষমতায় ছিল।
সেপ্টেম্বরে শ্রীলঙ্কার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এখনই সে বিষয়ে চূড়ান্ত কিছু বলা মুশকিল। তবে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে আশা করছেন, গত বছর তিনি দেশের যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন; একটা দেউলিয়া দেশকে আবারও ট্র্যাকে তুলেছেন, তা তাঁকে বিজয়ী হতে সাহায্য করবে। তবে তাঁর সঙ্গে পূর্বসূরি অজনপ্রিয় গোটাবায়া রাজাপাকসের যে সম্পর্ক, তাতে অনেক শ্রীলঙ্কান অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। গোটাবায়া ২০২২ সালে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন।
এ অঞ্চলের অন্যান্য নির্বাচনের ফল অনেকটা নিশ্চিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বর্জন করেছে। সেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সম্ভবত টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করবে। পাকিস্তানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে কারাগারে পাঠানোসহ বিরোধীদের ওপর কঠোর দমন-পীড়ন চলছে। ফলে বর্তমান শাসক জোটের নেতৃত্ব দানকারী পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
ভারতে এপ্রিল মাস থেকে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেখানে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি টানা তৃতীয় মেয়াদে জয়লাভ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেখানে জনপ্রিয়; অন্যদিকে বিরোধীরা দুর্বল ও বিভক্ত। ভারতের বেশির ভাগ ভোটার ক্ষমতাসীনদের বিজয়কে সাধুবাদ জানাবে। কিন্তু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে যেহেতু জনপ্রিয় বিরোধী দলগুলোকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে দুর্বল করা হয়েছে, সেখানে ক্ষমতাসীন দলগুলো বিজয়ী হলেও নতুন রাজনৈতিক উত্তেজনা দেখা দিতে পারে।
বৃহত্তর সংযোগের উদ্যোগ
দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে কম সংযুক্ত অঞ্চলগুলোর একটি হিসেবে কুখ্যাতি রয়েছে। তবে ২০২৪ হতে পারে সে ক্ষেত্রে মোড় ঘোরানো বছর। ভুটান এ বছর ভারতের সঙ্গে নতুন আন্তঃসীমান্ত রেল যোগাযোগের পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল মিলে একটি নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারত বহুপক্ষীয় পরিবহন প্রকল্পে স্বাক্ষর করেছে, যেখানে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোরের পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশ সমুদ্রের তলদেশে বড় টানেল নির্মাণ করেছে। চীনের অর্থায়নে পাকিস্তান রেলপথ নির্মাণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এর মাধ্যমে প্রত্যেকে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ জোরদার করার জন্য বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। এমনকি তালেবান নেতৃত্বাধীন আফগানিস্তানও চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে এবং সে লক্ষ্যে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
২০২৪ সালে এই বড় বড় প্রকল্প কতটা এগোবে তা বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে। একটি হলো নিরাপত্তা। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি নিয়ে চীন চিন্তিত; সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধি পেলে বিনিয়োগ পরিকল্পনা গতি হারাতে পারে। গাজা উপত্যকায় অব্যাহত যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ভারতের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারে। আরেকটি মূল বিষয় হলো অর্থায়ন। বিশেষ করে উচ্চাভিলাষী ভারত-ভুটান রেলপথ পরিকল্পনা, যার মধ্যে নতুন রাস্তা ও একটি বিমানবন্দর নির্মাণের কথা রয়েছে। সেখানকার অর্থায়ন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া ভারতের প্রকল্পগুলোতে আমলাতান্ত্রিক বিলম্বের ঝুঁকিও রয়েছে।
ভারতের গ্লোবাল সাউথ পরীক্ষা
এক বছর আগে ফরেন পলিসির এই দক্ষিণ এশিয়া ব্রিফ বিভাগে আমরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, ২০২৩ হবে ভারতের জন্য সুযোগ। একদিকে দেশটি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং অন্যদিকে বছরটিতে ভারত জি২০-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, যা বিশ্বব্যাপী তাদের ভাবমূর্তি বাড়ানোয় সহায়ক ছিল। ভারত আরও অনেক কিছু করেছে। ঐতিহাসিক চন্দ্র অবতরণ, ক্রিকেট বিশ্বকাপ, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনসহ অন্যান্য বৈশ্বিক ইভেন্টের আয়োজন করেছে।
২০২৪ সালে ভারত বাস্তবতায় ফিরে আসবে। দেশটি আর জি২০-এর নেতৃত্বে নেই। এই ফোরামটি দেশটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নত বিশ্ব এবং গ্লোবাল সাউথের মধ্যে সেতুবন্ধের মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা পালন করার সুযোগ দিয়েছিল। এটি ছিল ভারতের বিদেশনীতির শীর্ষ অগ্রাধিকারগুলোর অন্যতম। ২০২৪-এ ভারত সেই ভূমিকা জি২০ নেতৃত্বের সুবিধা ছাড়াই চালিয়ে যেতে চাইবে। নয়াদিল্লির সাফল্য পরিমাপ করার একটি কার্যকর উপায় হবে গ্লোবাল সাউথের ছোট দেশসহ অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তার উচ্চস্তরের কূটনৈতিক সম্পর্ক। এখানে ভারতের ওপরে রয়েছে চীন। চীন নিজেকে বিশ্বব্যাপী গ্লোবাল সাউথের নেতা হিসেবেও পরিচয় দেয় এবং ভারতের চেয়ে তার প্রভাবও বেশি। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে, সেখানে ভারতের অপেক্ষাকৃত কম উপস্থিতি রয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভারতের মতো শক্তিশালী নয়। সে জন্য ভারত বিশ্বব্যাপী গ্লোবাল সাউথের সেতুবন্ধ হওয়ার জন্য আরও বেশি দাবি করতে পারে। তবে ২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় ভারতের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের পর পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। এ নিয়ে দেশটিকে কাজ করতে হবে।
রাশিয়া ফ্যাক্টর
দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে বাইরের প্রভাবশালীদের মধ্যে চীন সম্পর্ক বেশি আলোচনার দাবি রাখে। তবে ২০২৪-এ রাশিয়া এ অঞ্চলে বড় খেলা খেলতে পারে। ২০২৩ সালে ভারতে সবচেয়ে বেশি অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করে রাশিয়া। এমনকি পাকিস্তানে প্রথম চালান পাঠায় রাশিয়া। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেন সার্গেই ল্যাভরভ। এর পর নভেম্বরে তিনটি রাশিয়ান নৌ জাহাজ বাংলাদেশে পৌঁছে এবং রাশিয়ার নৌ কর্মকর্তারা বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যৌথ নৌ মহড়ায় অংশ নেন।
রাশিয়া তার সীমানা ছাড়িয়ে প্রভাব বিস্তার করতে আগ্রহী এবং দেশটি দেখাতে চায়– ইউক্রেনের যুদ্ধে এটি দুর্বল বা বিচ্ছিন্ন নয়। সে কারণে রাশিয়ার জন্য দক্ষিণ এশিয়া শুধু বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবেই নিশানা নয়, বরং এ কারণেও– রাশিয়া এ অঞ্চলে তার অংশগ্রহণ বাড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি প্রভাব বিস্তার করতে চায়। এমনিতেই অঞ্চলটিতে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র প্রতিযোগিতা রয়েছে। এই পটভূমিতে ২০২৪ সালে নেপালকে দেখতে হবে। নেপাল সরকার ২০২৩ সালে রাশিয়ার সঙ্গে জলবিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগসহ আরও সহযোগিতা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একইভাবে চীন যখন আফগানিস্তানে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে, এর অর্থ হলো কাবুলও আগামী বছর রাশিয়ার কাছ থেকে আরও মনোযোগ পেতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ায় রাশিয়ার প্রভাব ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এ অঞ্চলে পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা আরও তীব্র করবে, যেটি দক্ষিণ এশিয়ার অনেক নিরপেক্ষ দেশের জন্য হতে পারে চ্যালেঞ্জিং।
মাইকেল কুগেলম্যান: উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক; ফরেন পলিসি থেকে ভাষান্তর