ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান আওয়ামী লীগের হয়ে তিনটি আসনের মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন। শেষমেশ মনোনয়ন পেয়েছেন একটি আসনে। অভিনেতা ফেরদৌসও ঢাকার একটি আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন। জাতীয় দলের নিয়মিত খেলোয়াড় হিসেবেই সাকিব সংসদ সদস্য বা এমপি হওয়ার দিকে মনোনিবেশ করেছেন। এর আগে ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা এমপি হয়েছেন। এমপি হয়েছেন মমতাজ বেগমসহ অনেক শিল্পী-অভিনেতা। খেলোয়াড়-শিল্পীদের এমপি হওয়ার বিষয় কতটা ইতিবাচক?
সাকিবের পরিসংখ্যানটা দেখা যাক। তিনি সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত জয় এনে দিতে পারেননি। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল এবং দলীয় অধিনায়ক উভয়ের হতশ্রী অবস্থা দেখা যায়। এর পরই দেখা গেল, অধিনায়ক এমপি হওয়ার টিকিট কিনেছেন। খেলায় তাঁর আগের অবদান নিশ্চয় স্বীকার্য। ভালো খেলেই তিনি বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার হয়েছেন। সেই সূত্রেই তিনি বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েছেন এবং নানা ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিয়েছেন। এখন তিনি এমপি হতে চাইছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তিনি জাতীয় দলকে কতটা দিতে পেরেছেন– সে প্রশ্ন উঠছে।
এখানে এমপি হওয়া যে বড় ব্যবসা, তা কে না জানে! এমপি হওয়ার পরের গল্প সম্পদ বৃদ্ধির। কারও সম্পদের পাহাড় গড়ার কৃতিত্বও রয়েছে! মাঝেমধ্যে সংবাদপত্রে তারা খবর হন। লাভজনক এই মাধ্যম যখন কেউ তাঁর পেশাদার জায়গার জনপ্রিয়তা দিয়ে বাগিয়ে নিতে চান, তখনই বিপত্তি ঘটে। মাশরাফি এমপি হয়েছেন, সাকিব হবেন। তাদের সূত্র ধরে এভাবে খেলোয়াড়রা আসবেন। কিন্তু ক্রিকেট দলের অবস্থা কী? আমাদের একটা সম্ভাবনাময় দল ছিল; অনেকের প্রত্যাশার জায়গা ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এ দল নিয়ে অনেকেই হতাশ। সমস্যা ক্রিকেট প্রশাসনেও। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড নিয়ে তো প্রশ্ন বিস্তর। দলীয়করণ সেখানেও অবক্ষয়ের জন্ম দিয়েছে। এমপি হওয়া যদি ব্যক্তিগত প্রাপ্তির উপলক্ষ হয়, সেই ক্রিকেট থেকে আমরা কী বা আশা করতে পারি! বিশেষ করে দেশে সেই অর্থে যদি ভোট উৎসব থাকত; সত্যিকারের প্রতিযোগিতায় এমপি হওয়ার পরিবেশ থাকত, তখনকার পর্যবেক্ষণ হতো ভিন্ন।
ক্রিকেট অঙ্গনের কথা বাদ দিলে যে চলচ্চিত্র তারকাদের এমপি হওয়ার প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে, তাদের গোড়ার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন-এফডিসি বলা চলে বেহাল।
এমপি হওয়ার ক্ষেত্রে আমরা যদি আদর্শ লক্ষ্যের কথা বলি, তবে সেটা জনগণের সেবা করা। যারা রাজনীতি করেন, এটা ঘোষণা দিয়েই করেন– তারা দেশ ও দশের সেবা করতে চান। তাদের কাছে যেন নিজের উন্নতির চেয়ে দেশের উন্নতিই মুখ্য। যেন তাঁর ক্ষমতা পাওয়ার মূলেও রয়েছে দেশ আর সবার গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা। অন্তত প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সংবিধান, গঠনতন্ত্র দেখলে তা-ই মনে হবে। কিন্তু আমাদের বাস্তবতায় যে কেউ বিভ্রান্ত হতে বাধ্য। সে জন্যই তারকাদের এমপি হওয়ার ঝোঁক দেখে মানুষ বিস্মিত হয়। সে জন্যই হয়তো সাকিব আল হাসান এক সময় তাঁর ফেসবুক পেজে পোস্ট দেন– ‘আই অ্যাম নট জয়েনিং পলিটিক্স অ্যান্ড আই ডোন্ট হ্যাভ অ্যানি ইনটেনশন টু জয়েন পলিটিক্স ইন মাই লাইফ।’ অর্থাৎ আমি রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছি না এবং জীবনে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার কোনো ইচ্ছাও আমার নেই। এক দশক পর অবশ্য সাকিব আর সেই অবস্থানে নেই।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের দখলে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়ী এমপি হয় ৬১ শতাংশ। অথচ ১৯৭৩ সালের সংসদে আইনপ্রণেতাদের প্রধান পেশা ছিল আইন ব্যবসা। তা ছাড়া পেশা হিসেবে ব্যবসা এবং কৃষিকাজও ছিল। সেই সময়ের সংসদে ৩১ শতাংশ আইনপ্রণেতা ছিলেন আইনজীবী এবং ১৮ শতাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী। নব্বই-পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে ব্যবসায়ীদের হার বাড়তে থাকে। সংশ্লিষ্টরা জানেন, রাজনীতিতে টাকার প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। খেলোয়াড়, শিল্পী কিংবা তারকাদের ক্ষেত্রেও এ সত্য অস্বীকারের সুযোগ সামান্যই। তাদের যে সম্পদ আছে, সেখান থেকে আরও বাড়িয়ে নেওয়াই থাকে অধিকাংশের লক্ষ্য। ২০১৮ সালের নির্বাচনী হলফনামার তথ্যে জানা গেছে, বয়সে ছোট ও রাজনীতিতে নবীন হলেও তারকা প্রার্থীদের মধ্যে সম্পদের শীর্ষে ছিলেন তৎকালীন জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। তাঁর সম্পদের ব্যাপারে গত বছরই যে খবর চাউর হয়, সেটি বিস্ময়কর। অবশ্য মাশরাফি তা অস্বীকার করেছেন।
খেলোয়াড়, শিল্পী, অভিনেতা তথা তারকাদের অনেক ফ্যান থাকে; যারা সংশ্লিষ্ট তারকার কাজের ভক্ত। এই ভক্ত অধিকাংশই তরুণ প্রজন্মের। কিন্তু এর আগে যে দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, অর্থাৎ ২০১৪ ও ’১৮ সালের নির্বাচনে তরুণ প্রজন্মের ভোটার অনেকেই তাদের কাঙ্ক্ষিত ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও যেভাবে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে তরুণদের শঙ্কা রয়েই যাচ্ছে।
শিল্পী-সাহিত্যিক-তারকারা আগে যেভাবে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলতেন; অন্যায় দেখলে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেন, এখন সে অবস্থানে নেই অনেকেই। এর সঙ্গে রাজনীতি থেকে লাভবান হওয়া এবং এমপি হওয়ার সম্পর্ক আছে বৈ কি। যখনই তাদের মধ্যে এমপি হওয়ার বাসনা থাকে কিংবা রাজনীতি থেকে কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা থাকে, তখনই আপসের মানসিকতা চলে আসে। এ অবস্থাও শঙ্কাজনক। দ্রব্যমূল্য যখন ঊর্ধ্বমুখী, তখন মানুষের পক্ষে কথা বলে নাগরিক সমাজ। তারা মানুষের পক্ষে, মানুষের কাতারে যোগ না দিলে মানুষ যাবে কোথায়?
এমপি হওয়া নিঃসন্দেহে খারাপ নয়, কিন্তু আমাদের সেই পরিবেশ-পরিস্থিতি নেই। নিজ অবস্থান ঠিক না রেখে, নিজের পেশাদার জায়গায় সর্বোচ্চটা না দিয়ে লাভজনক রাজনীতির এমপি হওয়া ভালো ফল আনতে পারে না। বিশেষ করে আমাদের রাজনীতিতে যেখানে অর্থ ও পেশিশক্তিই ভরসা, সেখানে তারকারা বেমানান। তারকারা এমপি হয়েই যে পরিবর্তনের পথে হাঁটবেন– সে ভরসা করার মতো পরিস্থিতি কি আছে? যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ।