ছয়বার বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে… ক্যাডারে প্রথম। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে এমন খবর পড়ে রাজা রবার্ট ব্রুসের ঘটনা মনে পড়ল। রবার্ট ব্রুস অবশ্য মাকড়সা থেকে শিক্ষা নিয়ে ছয়বার ব্যর্থ হয়ে সপ্তমবার সফল হয়েছিলেন। সেদিক থেকে বিসিএসের ওই পরীক্ষার্থী এক ধাপ এগিয়ে, যিনি ছয়বারের চেষ্টায় সফল হয়েছেন। সে জন্য সংবাদমাধ্যমের বাহবা তিনি পাচ্ছেন। বিসিএস নামক সোনার হরিণের পেছনে যেভাবে লেগে ছিলেন এবং অবশেষে তা যেভাবে ধরা দিল, তাতে বর্তমান বাস্তবতায় তিনি খবরের বিষয় হিসেবে এসেছেন।
সম্প্রতি ৪১তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল দেওয়ার পর এমন অনেকের ব্যাপারেই খবর হয়েছে। যারা বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন, তাদের গল্প যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি দুই বোনের একসঙ্গে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার খবরও আমরা দেখেছি। অনেকে কষ্টের মধ্যে বড় হয়ে ক্যাডার হয়েছেন; তাদের গল্পও এসেছে। অবশ্য তাদের নিয়ে আগে সংবাদমাধ্যমের এত মাতামাতি ছিল না। এখন সংবাদমাধ্যমের চোখে তারা হিরো; জনতার চোখে তো বটেই।
দুর্লভ কর্মসংস্থানকালে সরকারি চাকরি মূল্যবান। এর মধ্যে বিসিএস ক্যাডারের দাম অত্যন্ত বেশি। তার মধ্যে প্রশাসন কিংবা পুলিশ ক্যাডার মানে সেরাদের সেরা হওয়া। কেন তারা সেরা, সেটা অনুধাবন করা কঠিন নয়। স্থায়ী চাকরি, মাস শেষে ভালো মাইনে। এর সঙ্গে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, সামাজিক মর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি যেমন রয়েছে, তেমনি নিরাপদ অবসর যাপনের জন্য চাকরি শেষে রয়েছে পেনশন। সোনায় সোহাগা যখন এই বিসিএস, তখন তার পেছনে না ছোটার কোনো কারণ থাকতে পারে কি? সে জন্যই দেখা যাচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বাইরে গ্রন্থাগারগুলো হয়ে উঠেছে বিসিএস প্রস্তুতির কারখানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার প্রসঙ্গ সংবাদমাধ্যমে এসেছে। সেখানে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে ভোর থেকে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে থাকেন। এই যদি হয় অবস্থা, তবে গ্রন্থাগারে স্বাভাবিক সময়ে কোনো গবেষক এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ে পড়তে চাইলেও যেন তাঁর প্রবেশ করা দায়।
পাশাপাশি যে বিষয়টি নিয়ে বেশি আলোচনা সেটি হলো, প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করে এমনকি এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়েও অনেকে প্রশাসন, পুলিশ কিংবা পররাষ্ট্র ক্যাডারে চাকরি করছেন। বছর দুয়েক আগে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয়ে এখন বহু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। এবার ২৩ জনের মধ্যে ১৪ জনই ইঞ্জিনিয়ার, পাঁচজন ডাক্তার।’ এর মানে, একটি বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়া পররাষ্ট্র ক্যাডারের ২৩ জনের মধ্যে ১৯ জনই প্রকৌশল ও চিকিৎসাবিদ্যা পড়ে এসেছেন। সুযোগ আছে বলে তারা মেধার জোরে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভালো করে বিসিএস সাধারণ ক্যাডারে কাজ করছেন। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার তাঁর এক লেখায় বলেছেন, বিশেষায়িত ক্ষেত্র থেকে সাধারণ ক্যাডারে আসার দৃষ্টান্ত এমনকি পাকিস্তান আমলেও নাকি দেখা গেছে। কিন্তু বর্তমানে যে হারে তারা সাধারণ ক্যাডারে আসছেন, সেটা যে উদ্বেগজনক, তাও তিনি বলেছেন। কারণ সরকার তাদের পেছনে অনেক অর্থ খরচ করেছে। তাদের জন্য সরকারের বিনিয়োগ কিংবা জনগণের অর্থ খরচের অন্যতম কারণ, শুধু সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রেই তারা সেবা দেবেন। অবশ্য এর বিপরীতে সুযোগমতো যে কোনো কিছু করায় বাধা নেই। এমনকি এসব গ্র্যাজুয়েটের অনেকে তো দেশের বাইরেও চলে যান। তার পরও জনপ্রত্যাশা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
বিসিএস ক্যাডারদের নিয়ে এই মাতামাতির মধ্যে এটা মনে রাখতে হবে– সবার বিসিএস ক্যাডার হওয়ার সুযোগ নেই। সরকারি চাকরিতে এত বেশি পদ নেই যে, উল্লেখযোগ্য অংশকেও চাকরির সুযোগ দেওয়া যাবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক হিসাবে বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের চিত্রে দেখা যাচ্ছে, সরকারি চাকরি করেন মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ। এর বাইরে বেসরকারি চাকরির হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি তথা ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। অন্যান্য রয়েছে ২১ দশমিক ১ শতাংশ।
বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের এই অবস্থায় বিসিএস ক্যাডাররা সন্দেহাতীতভাবে ভাগ্যবান। তারা ভালো অবস্থানে আছেন, ঠিক আছে। কিন্তু দিনশেষে অন্যদের মতো তারাও চাকরি করছেন। এ চাকরি পেয়েছেন বলে তাদের গুণগান করা তথা এই অল্পসংখ্যক মানুষকে নিয়ে মাতামাতি করাটা যারা ক্যাডার হতে পারেননি, তাদের হতাশ করতে পারে। অথচ এ ক্ষেত্রে ‘অকৃতকার্য’ হওয়ার সংখ্যাই বেশি। স্মর্তব্য, ৪১তম বিসিএসের জন্য ২০১৯ সালে ৪ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। সেখান থেকে বিসিএস প্রিলিমিনারিতে অধিকাংশ বাদ পড়ে যান। এর পর লিখিত, ভাইভার পর বিসিএস ক্যাডার হিসেবে মাত্র ২ হাজার ৫২০ জনকে সুপারিশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন-পিএসসি। এর বাইরে অবশ্য ৯ হাজার ৮২১ জনকে নন-ক্যাডার হিসেবে তালিকা করেছে। সংখ্যার বিচারে ৪ লাখের মধ্যে এই অংশ কতটা নগণ্য, তা বলা বাহুল্য।
এখানে অনেকে কয়েক বছর চেষ্টা করে ক্যাডার হতে পেরেছেন। কিন্তু অধিকাংশই বাদ পড়েছেন। অথচ তারাও হয়তো চেষ্টা কম করেননি। এ ক্ষেত্রে সফলদের গল্প নিশ্চয়ই অনেকের জন্য প্রেরণার হবে; কিন্তু তা যে অনেককেই বিষণ্ন করবে না কিংবা তারা যে তাতে নিজেদের ‘ছোট’ ভাববেন না– এমন তো নয়। নিজেদের বাইরেও চাকরিহীনের জন্য সমাজ ও পারিপার্শ্বিক যে চাপ রয়েছে, তাও বুঝতে হবে। তা ছাড়া এটাও মনে রাখতে হবে, কোনো কাজই ছোট নয়। কোনো পেশাকেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।
সংবিধানের কথা যদি আমরা চিন্তা করি, সরকারি চাকরিজীবীরা আসলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তাদের কাজ মূলত জনগণের সেবা করা। সংবিধানের ২১ (২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ ১৩৩ নম্বর ধারায়ও ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মচারীদের’ কথা বলা হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং জনগণের সেবক হিসেবে তাদের সেই দায়িত্বানুভূতি থাকা দরকার। একই সঙ্গে সেই চাকরিজীবীদের নিয়ে মাতামাতির ক্ষেত্রেও সংবাদমাধ্যম ও অন্যদের সচেতন থাকা প্রয়োজন। সে জন্য হুজুগে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার চেয়ে আগে চিন্তা করা উচিত, অর্পিত দায়িত্ব আমরা কতটা যথার্থভাবে পালন করতে পারব। সংবিধানের আলোকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনগণের সেবক হওয়ার অর্থ– তারা নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে জনগণ তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। সেটা অনুধাবন করতে পারলেই বিসিএস নিয়ে মাতামাতি বন্ধ হতে পারে।