দারিও কলমেনারেস মিলান
ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক
সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক শরণার্থী সংকট যে রূপ নিয়েছে, তা আগে দেখা যায়নি। বর্তমানে সাড়ে তিন কোটির বেশি মানুষ সংঘাত, সহিংসতা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিশ্বব্যাপী জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির শিকার। গত মাসে বিশ্ব শরণার্থী দিবসে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষদের ব্যাপারে বৃহত্তর সচেতনতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে শরণার্থীদের চাহিদা ও অধিকার নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনার সুযোগ এখনও খুব সীমিত। এই শরণার্থীদের যেমন খাদ্য এবং বাসস্থানের চাহিদা রয়েছে, তেমনি ন্যায়বিচার এবং দুর্ভোগের স্মৃতিচারণ করার অধিকারও রয়েছে, বিশেষ করে যেহেতু তাদের এই পরিণতি মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে ঘটেছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বাস। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমার সরকার রাখাইনের অধিবাসী রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা চালালে প্রাণ বাঁচাতে তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গণহত্যা, জোরপূর্বক গুম, ধর্ষণ, নির্যাতন চালাচ্ছে। যার ফলে সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশে অবস্থানরত এসব শরণার্থী রোহিঙ্গার অধিকাংশই নারী ও শিশু। তাদের অন্যান্য চাহিদা পূরণের পাশাপাশি মনোসামাজিক সহযোগিতাও প্রয়োজন।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা বিশ্বের দায়িত্ব। এ লক্ষ্যে সত্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সত্য কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। সেখানে রোহিঙ্গারা তাদের দুঃসহ অভিজ্ঞতা জানাবে। জবাবদিহির প্রশ্নগুলো কমিশনই করবে এবং অপরাধীদের জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে তা সহযোগিতা করবে। শরণার্থীদের নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে তাদের নিজ দেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়ার অভিজ্ঞতা এবং বিদেশি ভূমিতে বাস্তুচ্যুত মানুষ হিসেবে তাদের বর্তমান পরিস্থিতির বিশদ বিবরণ নথিভুক্ত করা প্রয়োজন।
বিশেষত নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে এটি সত্য, যারা সংঘাত এবং জোরপূর্বক অভিবাসনের ফলে তুলনামূলক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের কণ্ঠস্বর ঐতিহ্যগতভাবে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সে অর্থে আসে না। একই সঙ্গে সংকট পেরিয়ে নতুন অবস্থানের আলোচনা, তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টার বর্ণনাও প্রত্যাশিত মাত্রায় প্রকাশিত হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেদের মতামত দিতেও আগ্রহী হয় না। উদাহরণস্বরূপ, কক্সবাজার রোহিঙ্গা শিবিরে সহিংসতার ঘটনা ঘটলে নারী বা শিশুরা এ নিয়ে কথা বলতে চায় না। তাদের ভয়, এতে নির্যাতনকারীরা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিশোধ নেবে।
যদিও শরণার্থীরা যে ধরনের সমাধান চায়, তার চ্যালেঞ্জ পরিস্থিতি অনুসারে ভিন্ন। তাদের গল্পে উঠে আসা বিষয় সমস্যা সমাধানের অংশ হতে পারে। এসব গল্প শুধু সংরক্ষণ করার জন্য নয়, বরং বিশ্বের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যও প্রয়োজন। একটি কার্যকর এবং টেকসই সমাধান কৌশল হলো সেখানে ওয়ার্কশপের আয়োজন করা, যেখানে শরণার্থী সম্প্রদায়ের নেতাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, যাতে তারা তাদের অধীনস্তদের সহায়তা করতে পারে।
থেরাপিউটিক আর্ট তথা সাংস্কৃতিক উদ্যোগ এবং নথিবদ্ধ করার প্রচেষ্টার সুবিধার্থে প্রশিক্ষণ দেওয়াও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। সেসব নথি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালেও প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য। এই উদ্যোগ ইতোমধ্যে কক্সবাজারে সফল বলে প্রমাণিত। সেখানে বিগত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এর প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়নের অংশ হিসেবে নির্বাচিত রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন কর্মশালায় অংশগ্রহণণের আমন্ত্রণ জানানো হয়। রোহিঙ্গাদের পরামর্শক, শান্তি স্থাপনকারী, অ্যাডভোকেট ও নথি সংরক্ষক হিসেবে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এসব কর্মশালা কার্যকর বলে প্রমাণিত।
এসব কর্মশালার অনেকই ছিল জেন্ডারভিত্তিক। নারীদের জন্য তাদের অভিজ্ঞতা এবং চ্যালেঞ্জ একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য একটি নিরাপদ স্থান প্রদান করা বা সম্মিলিত গল্প বলার বাহন হিসেবে সেলাইয়ের মাধ্যমে সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে। এর পর নারীরা তাদের পালিয়ে যাওয়া বাড়ির স্মৃতি রোমন্থন করে। তারা যে নৃশংসতা সহ্য করেছিল সে সম্পর্কে বলে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতের প্রত্যাশা আলাদা প্যানেলের গল্পে উঠে আসে।
সেলাইয়ের মাধ্যমে গল্প বলা উদ্যোগের উদ্বোধনী প্রকল্প ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও অনুপ্রাণিত করেছে। তারা বৃহত্তর নথিবদ্ধকরণ প্রচেষ্টার অপরিহার্য উপাদান। সেলাইয়ের মাধ্যমে গল্প ছাড়া হয়তো এসব অভিজ্ঞতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বলা বা রেকর্ড করা কঠিন হতো। এর বাইরে অতিরিক্ত পাইলট ওয়ার্কশপ নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য করা হয়। যাতে শরণার্থীদের আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে সমাজের করণীয় সম্পর্কে জানানো যায় এবং অ্যাডভোকেসি প্রচারাভিযান তৈরি, মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোসামাজিক সহায়তা প্রদান এবং ভবিষ্যতের জবাবদিহির জন্য ডকুমেন্টেশনের আরও ঐতিহ্যগত ধরন সংগ্রহ করা যায়।
যখন আনুষ্ঠানিক জবাবদিহির ব্যবস্থা অনিশ্চিত মনে হয়, তখন আমরা শরণার্থীদের গল্প বিশ্বের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে পারি। সেটা শরণার্থীদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দেওয়া এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্ভব। এ উদ্দেশ্যে ২০২২ সালে কক্সবাজারে একটি বছরব্যাপী চলচ্চিত্র নির্মাণ কার্যক্রম চালু হয়। প্রোগ্রামটির নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতারা, যারা রোহিঙ্গাদের চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং প্রশিক্ষক উভয়ই হতে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ওই অনুষ্ঠনের উদ্বোধনে অংশগ্রহণকারীদের একজন বলেছিলেন, ‘বিশ্বের কাছে যে বিষয়গুলো লুকিয়ে আছে কিংবা যে বিষয়গুলো তারা অনুভব করতে পারছে না, সেগুলো দেখানোর মাধ্যমে আমরা বিশ্বের চোখ খুলে দিতে চাই।’
সম্প্রতি কলম্বিয়ায় এমন একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। একুশ শতকের স্মৃতিচারণ এবং সত্য বলার এ উদ্যোগে সারাদেশে গ্রামীণ মানুষদের জীবন কাহিনির একটি নতুন পডকাস্ট সিরিজ চালু হয়। দুটি প্ল্যাটফর্মে তাদের বেঁচে থাকার গল্প প্রচার হয়। সেখানে উঠে আসে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে সরকার, বিদ্রোহী যোদ্ধা এবং আধাসামরিক বাহিনীর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের কারণে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর মাধ্যমে সেখানে কীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। বিশ্বের শরণার্থীদের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী ধরনের সহায়তা দিতে পারে এবং দেওয়া উচিত, তা এই সিরিজে উঠে আসে।
তবে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতিটি পাইলট কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের ফলোআপ জরিপে দেখা যায়, তারা যা শিখেছে তা বিশ্বের কাছে পৌঁছাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সে জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের প্রমাণও তারা দেখিয়েছে। তারা যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং উৎসাহ দেখিয়েছে সেটাই প্রমাণ করে– বিশ্বের শরণার্থীদের সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে আমাদের মৌলিক বিষয়গুলোর বাইরেও চিন্তা করতে হবে। আমাদের উচিত তাদেরকে তাদের কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে দেওয়া এবং তাদের গল্পকে নথিবদ্ধ করার মাধ্যমে তাদের ক্ষমতাবান করা।
তার মানে, শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানে শুধু বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ গ্রহণই যথেষ্ট নয়। প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে কার্যকর সুপারিশগুলো সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের কাছ থেকেই আসে। ভুক্তভোগী এবং বেঁচে যাওয়া নারী, পুরুষ, যুবক ও অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীসহ তাদের বড় অংশকে প্রক্রিয়াগুলোর অংশ করা দরকার।