নির্বাচনের বছরে প্রায় সব দলই নিজের মতো প্রস্তুতি নিচ্ছে। জাতীয় পার্টিও সেদিক থেকে পিছিয়ে নেই। দলটির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের ইতোমধ্যে দেশের ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সম্প্রতি জি এম কাদেরের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বৈঠক হয়। জাতীয় পার্টি যে নির্বাচনে যাচ্ছে– সেই বৈঠকেও তা নিশ্চিত করা হয়। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে গড়া এই রাজনৈতিক দলটি আগামী সংসদ নির্বাচনে বড় ধরনের চমক দেখাতে চায়।
কিন্তু জাতীয় পার্টি তো এখনও নিজের স্বতন্ত্র অবস্থানই পরিষ্কার করতে পারেনি। আমরা দেখছি, যে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলে বিএনপিসহ অপরাপর প্রায় সব বিরোধী দল সব ধরনের নির্বাচন বর্জন করছে; প্রায় একই অভিযোগ তোলার পরও জাতীয় পার্টি চলমান সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এর সঙ্গে আছে দলীয় কোন্দল। মঙ্গলবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদন বলছে, ঢাকা-১৭ সংসদীয় আসনে উপনির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। নিজের মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশীদকে তিনি ভোটে দাঁড় করাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর দল বিষয়টি নাকচ করেছে। এ বিষয়ে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সমকালকে বলেন, “প্রার্থী ঠিক করবে জাপার মনোনয়ন বোর্ড। মনোনয়ন দেবেন চেয়ারম্যান। এর বাইরে কে কী করছেন, সেগুলো ‘আউট অব সিলেবাস’। জাপা উপনির্বাচনে অংশ নেবে। যথাসময়ে প্রার্থী দেবে।”
রওশন এরশাদের সঙ্গে জি এম কাদেরের সম্পর্কের টানাপোড়েন আমরা বহু বছর ধরেই দেখে আসছি। যদিও এ বছরের শুরুতে বলা চলে, সরকারের মধ্যস্থতায় উভয়ের মধ্যে সমঝোতা হয়। উপরোক্ত ঘটনা প্রমাণ করে, সেই বিরোধ রয়ে গেছে। রওশন এরশাদ যাঁকে প্রার্থী দিচ্ছেন, তিনি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়ে জাপার প্রেসিডিয়ামে থাকা কাজী মামুনুর রশীদ। জি এম কাদের জাতীয় পার্টির দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বাদ পড়েন। স্মর্তব্য, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে রমজানের মধ্যে জি এম কাদের আয়োজিত জাতীয় পার্টির ইফতারে রওশন এরশাদ যোগ দেননি।
যদি নির্বাচনের আগে উভয়ের মধ্যে ঐক্য না হয়, তবে জাতীয় পার্টিতে একটা ভাঙনের শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আগের অভিজ্ঞতা বলছে, নির্বাচন এলেই ভাঙনের মুখে পড়ে দলটি। যদি দেবর-ভাবির মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক হয়ে যায়, পরিস্থিতি হবে ভিন্ন। তবে তখন অন্তত রওশনের অবস্থান বিবেচনায় দলটিকে ক্ষমতাসীনদের পরিকল্পনার অংশ হতে হবে। এর আগের নির্বাচনগুলোতেও আমরা দেখেছি, যখন বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছে তখন জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের ভূমিকায় ‘অভিনয়’ করে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যতা করে তোলার পথে সহযোগিতা করেছে। এর আগে বিরোধের মধ্যেও দেবর-ভাবিকে ঐক্যবদ্ধ করতে ক্ষমতাসীন দল যেমন সফল হয়েছে, নির্বাচনের আগে তেমনটা দেখা গেলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
তা ছাড়া জি এম কাদের মুখে সরকারের বিরোধিতা করলেও বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। চলমান সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রার্থিতার ক্ষেত্রেও সেটা স্পষ্ট। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল সাবেক সচিব এমএম নিয়াজউদ্দিনকে। তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল না। ভোট পাওয়ার দিক থেকে তিনি ষষ্ঠ অবস্থানে ছিলেন। আগামী সোমবার অনুষ্ঠেয় বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি এমন একজনকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে, তিনিও প্রভাবশালী নন। বরিশালের ক্ষেত্রে তিনি খুব একটা ফ্যাক্টর হবেন না বলে তেমন আলোচনায় নেই। অর্থাৎ জাতীয় পার্টি এমন প্রার্থী দাঁড় করাচ্ছে, যাঁদের কারণে সরকারদলীয় প্রার্থীরা সে অর্থে বিরক্ত হবেন না। এখানেও জি এম কাদেরের অবস্থান অনেকটা না ঘরকা না ঘাটকা।
সে জন্যই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির চমক হয়তো এমন– দলটি কীভাবে নির্বাচন করবে। এককভাবে, নাকি জোটবদ্ধভাবে– তা এখনই স্পষ্ট করছে না দলটি। জাতীয় পার্টি যদি এককভাবে নির্বাচনে যায়, তাহলে ক্ষমতাসীনরা লাভবান হবে। এই অর্থে যে, শেষ পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল নির্বাচনে না গেলে তখন জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারবে। কিন্তু জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি যদি বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধে, তখন সরকার বেকায়দায় পড়বে। সে কথাও অনেকে বলছিলেন, বিশেষ করে রমজানে জাতীয় পার্টির ইফতারে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল যোগ দেওয়ায় সেটা আরও আলোচনায় আসে। কারণ এক দশক পর জাতীয় পার্টির ইফতার পার্টিতে বিএনপি যোগ দেয়। যদিও সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। মনে রাখতে হবে, জি এম কাদেরসহ বর্তমানে জাতীয় পার্টির নেতৃস্থানীয় যাঁরা তাঁর সঙ্গে রয়েছেন, প্রায় সবাই একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তখন মহাজোট থেকে জাতীয় পার্টি ২৯ আসন পায়। জাতীয় পার্টির বর্তমান নেতাদের এমপি হওয়ার ক্ষেত্রে যখন ক্ষমতাসীনদের ‘অবদান’ রয়েছে, তখন তাঁরা সরকারি দলের বাইরে কতটা যেতে পারবেন– সেটাই দেখার বিষয়।
তারপরও রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। নির্বাচন আসতে আসতে পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে এবং সে অনুযায়ী প্রতিটি দলই তাদের নীতি গ্রহণ করবে। বিশেষ করে দলটি যখন জাতীয় পার্টি তখন তাদের নিয়ে আগাম মন্তব্য করা আরও কঠিন। কারণ দলটির প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের সময় থেকেই সে চিত্র আমরা দেখে আসছি। সকালে এক কথা আর বিকেলে আরেক কথা বলার কারণে তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন। তবে এটা ঠিক, জাতীয় পার্টির এখনও একটি ভোট ব্যাংক রয়েছে। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বাইরে এখনও জাতীয় পার্টির সমর্থক রয়েছে এবং উত্তরবঙ্গে দলটি বেশ শক্তিশালী। এ অবস্থায় দলটির নেতারা সব বিভেদ ভুলে যদি দলীয় সমর্থক গোষ্ঠীর প্রতি সুবিচার করে জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কর্মসূচি দেন, তবে জাতীয় পার্টি নিছক অন্যের হাতের পুতুল না হয়ে আবারও গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠতে পারে।