Mahfuzur Rahman Manik
মালালার সহপাঠী শাজিয়ার প্রত্যয়
মার্চ 8, 2023

মূল: গর্ডন ব্রাউন

ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক

শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শাজিয়া রমজান তাঁর তারুণ্যের অধিকাংশ সময় ব্যয় করছেন। ২০১২ সালে ১৪ বছর বয়সে উত্তর পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় বান্ধবী মালালা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গে বাসে একত্রে স্কুল থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে চরমপন্থিদের বন্দুক হামলার শিকার হন। চরমপন্থিদের লক্ষ্য ছিল সেখানকার কিশোরীদের শিক্ষা থেকে বিরত রাখা। গুলিতে আহত শাজিয়া, মালালা ও তাঁদের বান্ধবী কাইনাতের সুস্থ হতে কয়েক মাস লেগে যায়। স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি থেকে নার্সিং ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর শাজিয়া এখন পাকিস্তানে নিজস্ব্ব নার্স প্রশিক্ষণ স্কুল চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শাজিয়ার চিন্তাজুড়ে সব সময় রয়েছে তাঁর এলাকার মেয়েদের চাহিদা পূরণের বিষয়। ক্লাসের মাঝখানের সময়ে তিনি পাকিস্তানি দাতব্য সংস্থাগুলোর জন্য তহবিল সংগ্রহ করছেন, যা নীরবে কিন্তু কার্যকরভাবে আফগান মেয়েদেরও সাহায্য করছে। সেখানে তালেবান মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ করার কারণে তাদের শিক্ষার সুযোগও হারাতে বসেছে।
আফগানিস্তানে ৫০ লাখ মেয়ে এখন স্কুলের বাইরে। তাদের জরুরিভাবে আমাদের সহায়তা করা প্রয়োজন। কাবুলের রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে অনেকেই নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। যদিও তালেবান শাসন একদিন বুঝবে- নিপীড়ন করে চিরকালের জন্য সাহসী নারীকে দমানো যায় না। বর্তমানে সেখানে তরুণ প্রতিবাদকারীরা গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের মুখোমুখি। তাঁদের সাহস ও দৃঢ়তার না বলা গল্প আমরা জানি। আফগানিস্তানের মেয়েরা তাদের পিতামাতা ও শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত গোপন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলেও শাস্তি ও মারধরের ঝুঁকিতে পড়ছে। সে জন্য অনেকে শিক্ষার আশায় সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে নির্বাসনে চলে যাচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানেও সংকট থাকার কারণে সমস্যা আরও তীব্রতর হচ্ছে এবং সেখানে ২ কোটি ৩০ লাখ শিশুর শিক্ষা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এ সমস্যা তীব্র হয়েছে শুধু সাম্প্রতিক বন্যার কারণে নয়, যার প্রভাবে পাকিস্তানে ২৭ হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। বরং সমস্যা হলো, নারী শিক্ষায় বিনিয়োগে পাকিস্তান দীর্ঘ মেয়াদে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
এই মেয়েরা বিশ্বের ২০ কোটি ২০ লাখ শিশুর একটি অংশ মাত্র, যাদের জন্য শিক্ষা সহায়তা খুব জরুরি। তাদের মধ্যে চার কোটি মেয়েসহ প্রায় আট কোটি শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যাচ্ছে না। আর অন্যরা তাদের শিক্ষা অর্জনের পথে এত বেশি বাধার সম্মুখীন হয়েছে যে, তারা এমনকি মৌলিক সাক্ষরতা এবং সংখ্যার দক্ষতা অর্জনেও ব্যর্থ হয়েছে। তাদের সংখ্যা এত বেশি, তারা এরই মধ্যে জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সম্মিলিত জনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে এবং প্রতি বছর সংখ্যাটি বাড়ছে। ইউক্রেন এবং মিয়ানমার থেকে শুরু করে কঙ্গো, সুদান, ইথিওপিয়া ও সোমালিয়া পর্যন্ত ১০ কোটিরও বেশি মানুষ সংঘাত ও গৃহযুদ্ধের কারণে উদ্বাস্তু বা বাস্তুচ্যুত।

আজ বিপুলসংখ্যক শিশু নির্বাসিত হয়েছে শুধু যুদ্ধের কারণে নয়; বরং তারা তেমন পরিণতি বরণ করছে খরা, বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অন্যান্য দুর্যোগ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে। তুরস্ক ও সিরিয়ায় এখনও মৃতদের সংখ্যা বাড়ছে। তবে আমাদের অবশ্যই জীবিতদের জরুরি প্রয়োজন দেখতে হবে, সেখানে যারা ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের জেরে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাদের পুনরুদ্ধার করতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের খাওয়ানো, আশ্রয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি; তবে অস্থায়ী শিক্ষা প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করতে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অতীতের তুলনায় আমরা আরও ভালো কাজ না করলে ভূমিকম্পের শিকার শিশুরা বছরের পর বছর শিক্ষা থেকে বাদ পড়তে পারে।
তুরস্ক ও সিরিয়ায়ও অন্য জায়গার মতো মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইউনেস্কোর তথ্য অনুসারে ছেলেদের তুলনায় তাদের স্কুল থেকে ঝরে যাওয়ার শঙ্কা ৩৫ শতাংশ বেশি। এ আশঙ্কাও রয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের অনেককে বাল্যবিয়েতে বাধ্য করা হবে। অনেক বছর পর যখন জোরপূর্বক বিয়ের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল; বাল্যবিয়ের সংখ্যা আবার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতিরিক্ত এক কোটি মেয়ের বাল্যবিয়ে হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

শিশুদের শেখার সুযোগের জন্য যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব কমে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা উচিত হবে না। শিক্ষার বাইরে থাকা ২০ কোটি ২০ লাখ শিশুর শিক্ষার অর্থায়নে ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এডুকেশন ক্যান নট ওয়েট-ইসিডব্লিউ উদ্যোগ। আমি এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। ইসিডব্লিউর সম্মেলন এই সপ্তাহে জেনেভায় অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে যুক্তরাজ্যের অ্যান্ড্রু মিচেল ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন। ইসিডব্লিউ তার নতুন কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দাতাদের কাছে দেড় বিলিয়ন ডলার চাইছে। এর মাধ্যমে শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে, পাচার প্রতিরোধসহ নিরাপদ স্কুলের ব্যবস্থা ও মেয়েদের শ্রেণিকক্ষ থেকে অপহরণ বন্ধে কাজ করবে। অনলাইন শিক্ষার সম্প্রসারণ ও লেবাননে দুই শিফটে বিদ্যালয়গুলোতে যেখানে স্থানীয় শিশুদের সকালে ইংরেজি ও ফরাসি এবং বিকেলে সিরিয়ান শরণার্থী শিশুদের আরবি শেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানকার বিদ্যালয় ভবনগুলোর আরও কার্যকর ব্যবহারে ব্যয় করা হবে।
সাম্প্রতিক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি থেকে আমরা জানি, যখন খাদ্য কন্টেইনার ও উদ্ধারকর্মীরা অবরুদ্ধ শহরের মধ্য দিয়ে যেতে পারে না এবং উদ্বাস্তু বহনকারী ছোট নৌকা সমুদ্রে ডুবে যায়, তখন আশা মরে যায়। যখন শিশুরা শিক্ষার বাইরে থাকে এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হয়, তখনও আশা মরে যায়। ১১, ১২ কিংবা ১৩ বছর বয়সীরা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর থাকে। তারা যে সুযোগ পায়, তা নিয়েই তারা উচ্ছ্বসিত থাকে। আমি গ্রিসের মোরিয়াতে শরণার্থী শিবিরের দাতব্য কর্মীদের কাছ থেকে শোনা একটি কথা ভুলতে পারি না, যারা তাদের কিশোর বয়সে তিন শরণার্থীকে আবিস্কার করেছিল। তারা এতটাই হতাশ ছিল; সবাই মিলে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করছিল। কাঁটাতারের এমন শরণার্থী শিবিরে তাদের বাস, যেখানে কোনো স্কুলশিক্ষা নেই। অন্য যা ছিল তাও সামান্য। তারা শুধু হতাশার অন্ধকার দেখছিল।

এর পরও আশা জেগে থাকে। এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর ও হতাশার জায়গায়ও যদি আমরা শিশুদের শিক্ষার সুযোগ দিই, তা আশার সলতে জ্বালাতে পারে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৪-এ যেভাবে প্রত্যেক ছেলেমেয়ে; সে রাষ্ট্রহীন হোক বা না হোক, তার স্কুলে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেই লক্ষ্য পূরণে বিশ্ব সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসা উচিত। শাজিয়ার কাজ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে আমরা কতটা নৈতিক বাধ্যবাধকতায় যুক্ত। বিশ্বের কিছু অংশের কিছু শিশুর সম্ভাবনার বিকাশ না করে আমাদের উচিত সব জায়গার প্রত্যেক শিশুর সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানো।

সমকালে প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।