Mahfuzur Rahman Manik
পা টেপার রাজনৈতিক ফজিলত
মার্চ 29, 2023

গত প্রায় দেড় দশকে বিশেষত যখন থেকে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আছে; বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বারবার নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। সর্বশেষ, সরকারি দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম এ সংগঠনটি আলোচনায় এসেছে একটি ছবির কারণে– পা টেপার ছবি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতোমধ্যে ভাইরাল সে ছবিতে দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকটক দেখছেন সেখানকার ছাত্রলীগ সভাপতি এবং তাঁর পা টিপছেন দুই ছাত্রলীগ নেতা। সমকালের প্রতিবেদন অনুসারে, ছবিটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত হলের।

আধুনিক সমাজ ও সংস্কৃতিতে এ ধরনের চিত্র অকল্পনীয়। গল্প হিসেবে এসব আমরা শুনেছি, আগেকার দিনে জমিদারেরা তাঁদের গৃহভৃত্য বা মোসাহেবদের দিয়ে এ ধরনের কাজ করাতেন। আলোচ্য ছবিতে তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শুধু নয়; পরস্পর সহকর্মীও বটে। অর্থাৎ তাঁরা কেউই কারও ভৃত্য নন। তারপরও কেন তাঁরা এমন লজ্জাজনক ঘটনা ঘটালেন, তা অবশ্য অনুধাবন করা কঠিন নয়। ছাত্রলীগ পদ-পদবির বিষয়কে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে; নেতাদের ভৃত্যের মতো সেবা না করা পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই তা লাভ কঠিন। সংগঠনটিতে পদ বাণিজ্য এখন কোনো আড়াল-আবডালের বিষয় নয়।

এখন কারও অজানা নয়, নতুন শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার পরই আবাসিক হলে সিটের জন্য ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের পেছনে দিনের পর দিন ঘুরতে হয়। তাঁদের কাছে গেস্টরুম এক আতঙ্কের নাম। সেখানে নবীন শিক্ষার্থীকে কথিত আদব-কায়দা শেখানোর নামে বিভিন্ন প্রকার শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা হয়। গ্রাম থেকে উঠে আসা মেধাবীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শুরুতেই এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। হলের বাইরে শহরে অবস্থান করার মতো অনেকের সামর্থ্য না থাকায় শিক্ষার্থীরা মুখ বুজে এসব সহ্য করেন। এমনকি প্রশাসনকে জানাতেও ভয় পান। ছাত্রনেতারা যখন র‍্যাগিংয়ের নামে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন আচরণের সুযোগ পান, তারই ধারাবাহিকতায় পা টেপাতে তাঁরা কুণ্ঠা বোধ করেন না। ফলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল হক রুবেল, অর্থাৎ যাঁর পা টিপছিলেন তাঁরই কমিটির দুই সদস্য, ১০ বছর আগে তাঁর ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও তিনি কীভাবে দায়িত্ব পালন করছেন? গত বছরের জুলাইয়ে সমকালে তাঁকে নিয়ে সংবাদ শিরোনাম হয়– পরিসংখ্যান পড়তে পড়তে ‘আদু ভাই’। ১৭ বছর আগে ভর্তি হওয়া এই নেতা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজত্ব করছেন। তাঁর নানা অপকর্মও সমকালে ওই প্রতিবেদন উঠে আসে। এমনকি তিনি শাহ আমানত হলে ৩১১ নম্বর কক্ষে একাই বাস করছেন, অবৈধভাবে। তাঁর সঙ্গে যাঁরা পড়াশোনা করেছেন; অনেকেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক। ক্ষমতার মধ্যে ‘মধু’ আছে বলেই এত বছর ধরে তিনি এভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছেন।

তাঁর মতো বয়স্করা যদি এভাবে ছাত্র সংগঠনে নেতৃত্ব দেন, তা দুঃখজনক নিঃসন্দেহে। আমরা দেখছি, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অন্তত সাম্প্রতিক সময়ে এভাবে আদু ভাইদের নেতৃত্বে আনা হয় না। তবে অন্য শাখাগুলোতে কেন তাঁরা বহাল থাকবেন? শুধু বহাল থাকাই নয়; নানা অপরাধ করা সত্ত্বেও তাঁদের নেতৃত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠছে না। দলের পক্ষ থেকে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিট বাণিজ্য, শিক্ষার্থী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারামারি ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িয়ে পড়ছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার ফুলপরীর মতো এমন কিছু ঘটনা সামনে এলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা ভয়ে নিপীড়নকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে সাহস করেন না।

দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার মতো কিংবা দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড করার পর কোনো নেতার দায়িত্বে থাকা উচিত নয়। অপরাধ সে যে-ই করুক, তার শাস্তি হওয়াই কাম্য। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতাকর্মী হওয়ায় অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও তার শাস্তি না হলে অপরাধী আরও বেপরোয়া হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ তো বটেই; তাদের অভিভাবক হিসেবে আওয়ামী লীগেরও দায় রয়েছে। ছাত্রলীগ হলেও আমরা দেখছি, সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা কারও না কারও প্রশ্রয় পেয়ে থাকে এবং সেখানেও গ্রুপিং, দলাদলি, মারামারি। এ ক্ষেত্রে দলের নীতিনির্ধারকদের কঠোর হওয়া প্রয়োজন।

একজন নেতা কতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন হলে তারই সহকর্মীকে দিয়ে পা টেপানোর মতো কাজ করতে পারেন! বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীমাত্রেরই আত্মসম্মানবোধ আছে। কিন্তু এই বোধ ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতাদের কতটা রয়েছে– তা নিয়েই প্রশ্ন। এমন নেতাদের প্রশ্রয় দেওয়া; অপরাধ করার পরও দায়মুক্তি দেওয়ার সংস্কৃতি চালু থাকার কারণেই ছাত্রলীগ নেতিবাচক শিরোনাম হওয়া থেকে নিজেদের বের করতে পারছে না। খুনের ঘটনায় জড়িত থাকা নেতাকর্মীর প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানোর খবর সংবাদমাধ্যমে আসার পরও কেন তারা গ্রেপ্তার হবে না? কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশাসন চাপের মুখে থেকে গ্রেপ্তার করলেও ছাড়া পাচ্ছে। যে কারণে ছাত্রলীগের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ কিংবা সরকারের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

ছাত্রলীগের মতো ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের পথ হারানো দুর্ভাগ্যজনক। যে সংগঠনটি ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের সব সংকটে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছে; এখন সেটি কেন লাগামহীন হবে? ছাত্রসমাজের দাবিদাওয়া আদায় ও সংকটে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার পরিবর্তে যখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী নেতিবাচক ঘটনায় সামনে আসছে, তখন দলটির নীতিনির্ধারকদের উদাসীন থাকার সুযোগ নেই।

পা টেপানোর ছবিটি সামনে আসার পরই উচিত ছিল সংশ্লিষ্ট নেতাকে জবাবদিহিতে বাধ্য করা। কিন্তু সেটি হয়েছে বলে আমরা জানি না। তবে নেতিবাচক ধারা থেকে ইতিবাচক ধারায় ফিরতে আমরা মনে করি, এখনও সময় শেষ হয়ে যায়নি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ঘটনা থেকেই যদি সংগঠনটি চায়, ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এ জন্য প্রথম দফা হওয়া উচিত অপরাধের ক্ষেত্রে শূন্য সহিষ্ণুতা প্রদর্শন। অপরাধীদের বিরুদ্ধ কঠোর হওয়া, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের শাস্তির আওতায় আনা ও সাধারণ ছাত্রদের পক্ষে দাঁড়ালে ছাত্রলীগের ঐতিহ্য ফেরানো কঠিন হবে না। ছাত্রলীগ ও সংগঠনটির নীতিনির্ধারকরা কি এই পথে হাঁটবেন?

সমকালে প্রকাশ ২৩ মার্চ ২০২৩

ট্যাগঃ ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।