Mahfuzur Rahman Manik
মধ্যম আয়ের বাংলাদেশে উদ্ভাবনের চ্যালেঞ্জ নিতে হবে এনজিওগুলোর
ফেব্রুয়ারী 9, 2023

সাক্ষাৎকার: ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মাহফুজুর রহমান মানিক

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ব্র্যাকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি একই সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পিপিআরসির এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান। তিনি সার্ক পভার্টি কমিশনেরও সদস্য ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির গ্র্যাজুয়েট হোসেন জিল্লুর রহমান পিএইচডি করেছেন যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে তাঁর জন্ম।

সমকাল: ব্র্যাকের ৫০ বছর পূর্তির শেষ অনুষ্ঠান হচ্ছে 'হোপ ফেস্টিভ্যাল'। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া তিন দিনের এ অনুষ্ঠানের বিশেষত্ব কী? 'হোপ'-এর ব্যাখ্যাই বা কী?

হোসেন জিল্লুর রহমান: গত বছর মার্চে ব্র্যাক তার ৫০ বছর সম্পন্ন করে। বছরব্যাপী নানামুখী আয়োজনের সমাপনী অনুষ্ঠান এই হোপ ফেস্টিভ্যাল। ব্র্যাক টিম অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই বছরওয়ারি আয়োজন সাজিয়েছে।
হোপকে যেমন আমরা ভবিষ্যতের আশা অর্থে ব্যবহার করতে পারি, তেমনি একে আরও নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এটি যেমন ব্র্যাকের কর্মী বাহিনীর জন্য অনুপ্রেরণার উৎসব, তেমনি অন্যরাও এ থেকে উদ্দীপনা নিতে পারেন। আমাদের দেশ নানামুখী চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করছে। এখানে অর্থনীতি, সুশাসন, রাজনীতি- সব জায়গায় একটি সংকট যেমন স্পষ্ট, তেমনি এর সঙ্গে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ একত্র হয়ে সমস্যা আরও তীব্রতর হচ্ছে। কিন্তু এসব সমস্যা তো আমাদেরই সমাধান করে এগোতে হবে। তাই এর মধ্যেও সমাধানমুখী চিন্তা লালন করা, সফলতা থেকে শিক্ষা নেওয়া, সংকট মোকাবিলায় নিজের মধ্যে প্রেরণা তৈরি করা- সব মিলিয়েই এই হোপ ফেস্টিভ্যাল।

সমকাল: এ ফেস্টিভ্যাল কি কোনো পরিবর্তনের কথা বলছে?

হোসেন জিল্লুর রহমান: পরিবর্তন একটি নিত্য প্রক্রিয়া। অর্ধশতাধিক বছর ধরে আমরা নানামুখী পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। আগের সমস্যা আর এখনকার চ্যালেঞ্জ এক নয়। পুরোনো ও নতুন চ্যালেঞ্জ সমাধানে নিজের মধ্যে এক ধরনের সংকল্প ও পরিবর্তনের তাগিদ অনুভব করা জরুরি। অন্যদের মধ্যেও এই তাগাদা তৈরি করা জরুরি। সংকট সমাধানে সে জন্য উদ্ভাবনী চিন্তা, সুনির্দিষ্ট কৌশলও এর বাইরে নয়।

সমকাল: স্যার ফজলে হাসান আবেদ যে স্বপ্ন নিয়ে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এটি তার কতটা কাছাকাছি পৌঁছেছে?

হোসেন জিল্লুর রহমান: আবেদ ভাইয়ের স্বপ্ন শুধু কয়েকটি গন্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করা ঠিক হবে না। মানে এমন নয় যে, আমরা ওই পর্যন্ত যাব, এর পর আমাদের পথ শেষ। তাঁর স্বপ্ন ছিল ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের জীবন পরিবর্তন করা। সেই চ্যালেঞ্জ এখনও স্পষ্ট। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও নারীর অধিকারসম্পন্ন সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্ন তিনি দেখেছেন। তাই প্রশ্নটা হওয়া উচিত- তিনি যেভাবে স্বপ্ন দেখেছেন, সেই মিশনে ব্র্যাক কতটা রয়েছে। এখানে আমার উপলব্ধি- আবেদ ভাইয়ের মিশনে ব্র্যাক পুরোপুরি রয়েছে। সময়ের আলোকে নতুন নতুন কর্মসূচি গ্রহণও তার বাইরে নয়। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন একটি সংকট। সুপেয় পানির সংকট কোথাও কোথাও বড় সমস্যা। নগর দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর উন্নম্নয়ন- সব ক্ষেত্রে আমরা চেষ্টা করছি এবং এগোচ্ছি। সব সমাধান আমরা জেনে গেছি- এমন আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। প্রতিনিয়ত কাজ করে যাওয়া এবং তার কার্যকারিতার পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ।

সমকাল: ৫০ বছরে ব্র্যাকের বহুমাত্রিক বিকাশ ঘটেছে। দেশের বাইরেও এর বিস্তৃতি। ব্র্যাক আবার উদ্যোক্তা হিসেবেও কাজ করেছে। এটা কতটা জরুরি ছিল?

হোসেন জিল্লুর রহমান: ব্র্যাক উদ্যোক্তা হিসেবেও সফল হিসেবে প্রমাণিত এবং আমি মনে করি, এটি জরুরি ছিল। এর দুটি দিক। প্রথমটি হলো, প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি ব্র্যাককে আরও টেকসই করেছে; আবার ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের টেকসই পরিবর্তনের জন্যও এটি জরুরি ছিল। তা ছাড়া মানুষের কর্মসংস্থানেও এটি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। আড়ংয়ের উদাহরণ নেওয়া যায়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ যেটি ঘটেছে সেটি হলো, গ্রামীণ নারীদের সুযোগ তৈরি। আড়ং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাজারের সম্পর্ক তৈরি করেছে। আড়ং ডেইরি, সেখানেও একই অবস্থা। ব্র্যাক যেমন নতুন বাজার তৈরি করেছে এবং বাজারের সঙ্গে দরিদ্র মানুষকে সংযুক্ত করেছে; একই সঙ্গে পণ্যসেবার মানও তৈরি করেছে। গুণগত মান বজায় থাকার কারণে বাণিজ্যিকভাবেও ব্র্যাকের অনেক উদ্যোগ সফল হয়েছে।

সমকাল: দেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য বেকারত্ব এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তাদের দক্ষ জনগোষ্ঠী হিসেবে তৈরি ও কর্মসংস্থানে ব্র্যাক কতটা ভূমিকা রাখছে?

হোসেন জিল্লুর রহমান: ব্র্যাক মানবসম্পদ উন্নয়নে বরাবরই ভূমিকা পালন করে আসছে। আগে ব্র্যাক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশুদের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য সারাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এখন নতুন চ্যালেঞ্জ তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা। এই দক্ষতা শিক্ষায় ব্র্যাকের নানামুখী উদ্যোগ চলমান। নারীদের গাড়ি চালনায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ব্র্যাক। তা ছাড়া অভিবাসী শ্রমিকদের কল্যাণেও এর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। ব্র্যাক উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করতে গড়ে তুলেছে 'আমরা নতুন নেটওয়ার্ক'। হোপ ফেস্টিভ্যালে ১০ জনকে দেওয়া হবে আমরা নতুন ইয়াং চেঞ্জমেকারস অ্যাওয়ার্ড। এর মাধ্যমে নতুন চিন্তা এবং কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

সমকাল: ক্ষুদ্রঋণ ব্র্যাকের অন্যতম কাজ। সময়ের আলোকে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা কতটা জরুরি?

হোসেন জিল্লুর রহমান: ক্ষুদ্রঋণ ব্র্যাকের অন্যতম স্তম্ভ। বলা বাহুল্য, সময়ের আলোকে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। ক্ষুদ্রঋণ এখন আর সেই অর্থে ক্ষুদ্র নেই। একটা সময় ছিল, যখন গ্রামের নারীদের অল্প কিছু ঋণ দেওয়া হতো এবং কিস্তিতে তাঁরা সেটি শোধ করতেন। এখন ক্ষুদ্রঋণের কয়েকটি ধরন তৈরি হয়েছে। ব্র্যাকের রয়েছে দাবি কর্মসূচি; রয়েছে প্রগতি এবং ইউপিজি। দাবি হলো দরিদ্রদের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ। যাঁরা কিছুটা অবস্থাপন্ন, ব্যবসার জন্য তাঁদের ঋণ দেওয়ার কার্যক্রম হলো প্রগতি। প্রগতি এসএমই অর্থাৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ দেয়। তাঁরা প্রয়োজন অনুসারে অর্থ পেয়ে থাকেন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম ইউপিজি-আল্ট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন। অর্থাৎ যাঁরা একেবারে হতদরিদ্র তাঁদের দারিদ্র্য থেকে বের করার কার্যক্রম রয়েছে। ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করছি।

সমকাল: কী সেই পরিবর্তন?

হোসেন জিল্লুর রহমান: বলা হয়, প্রয়োজনই আবিস্কারের জননী। এ ক্ষেত্রে সেটিই ঘটেছে। কভিড-১৯ এর সময় ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমেও সাময়িক স্থিতাবস্থা দেখা দেয়। তার অব্যবহিত পরে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের ব্যাপক ডিজিটাইজেশন হয়েছে। এর মাধ্যমে বেনিফিশিয়ারিরা যেমন অনলাইনে আবেদন করতে পারেন, তেমনি মোবাইল ফোনেও এর সুবিধা পৌঁছানোর কার্যক্রম চালু হয়েছে। এখন আগের চেয়ে কাগজপত্রের ব্যবহার অনেক কমে গেছে। অনলাইনের মাধ্যমে সবার সুবিধা নিশ্চিত হয়েছে। এখানে ক্ষুদ্রঋণের আরেকটি বিষয় বলা দরকার। ব্র্যাক সিজনাল তথা সময়ে সময়েও প্রয়োজনে ঋণ দিয়ে থাকে। যেমন কোরবানির জন্য কারও সাময়িক ঋণ লাগতে পারে কিংবা ঈদের সময় দোকানের জন্য ঋণ লাগে বা তরুণদেরও ঋণ দেয়। ব্র্যাক বোর্ডের মিটিংয়ে আমরা ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখেছি, ব্র্যাক ঋণে পরিশোধের হারও খুব ভালো।

সমকাল: সময় ও চাহিদার পরিবর্তনে বাংলাদেশের উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ও অগ্রাধিকারে কেমন পরিবর্তন দরকার?

হোসেন জিল্লুর রহমান: বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে এখানে বিদেশি অর্থায়নেও পরিবর্তন আসছে। আগে এক ধরনের দাতা সংস্থা অর্থায়ন করত; এখন অন্য ধরনের বিদেশি প্রতিষ্ঠান আসছে। যেমন বিল গেটস ফাউন্ডেশন এখন স্বাস্থ্যসেবায় এগিয়ে আসছে। আবার ব্র্যাক নিজেই নিজের সামাজিক কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন করছে। সার্বিকভাবে এনজিও জগৎ এখন নতুন কর্মসূচি উদ্ভাবনের চ্যালেঞ্জে রয়েছে। নতুন চাহিদাও তৈরি হয়েছে, যেখানে এনজিওগুলোর এগিয়ে আসা প্রয়োজন। যেমন যারা দারিদ্র্য অবস্থার ওপরে কিন্তু প্রয়োজন সাশ্রয়ী মূল্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মানসম্মত সেবা, তাদের জন্য ব্র্যাক নতুন উদ্যোগ সাজাচ্ছে। সফলতা এখানে নিশ্চিত নয়, কিন্তু উদ্যোগ নেওয়াতে ব্র্যাক বসে নেই। ব্র্যাক এখন অনেকের 'পার্টনার অব চয়েস'। ব্র্যাক নিজেকে আস্থা ও বিশ্বস্ততার জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছে। সে জন্য আমরা দেখছি, কভিডের সময় সরকারের ভ্যাকসিন কার্যক্রমে প্রতিষ্ঠানটি সহায়তা করেছে। সুনামগঞ্জের বন্যা মোকাবিলাতেও ব্র্যাক ভূমিকা রেখেছে।
সমকাল: সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। সেখানে উন্নয়ন সংস্থাগুলো কীভাবে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারে?

হোসেন জিল্লুর রহমান: গত ৫০ বছরের খতিয়ান দেখাচ্ছে, ব্র্যাক ও অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছে। আগামীতেও সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থার যথাযথ ভূমিকার প্রয়োজন রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে আগ্রহ লাগবে। যেমন সরকার শিক্ষা খাতে ব্যাপক ব্যয় করছে। তারপরও সেখানে সমস্যা রয়ে গেছে। বিশেষ করে শিক্ষক প্রশিক্ষণের কথা বলা যায়। সরকার চাইলে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্র্যাককে কাজে লাগাতে পারে। নগর স্বাস্থ্য, বিশেষ করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ব্র্যাকের যে সাংগঠনিক দক্ষতা রয়েছে, সেটি কাজে লাগাতে পারে। আবার বিচার ব্যবস্থায় মামলার যে জট রয়েছে, সেখানে মামলাজট কমাতে এডিআর তথা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে উন্নয়ন সংস্থাগুলোকেও কাজে লাগাতে পারে। আমরা জানি, বিমানবন্দরে ব্র্যাকের বিশেষ অভিবাসী কর্নার রয়েছে। সেখানে কোনো অভিবাসী সমস্যায় পড়লে সরকারের দায়িত্বশীলরাই সমাধানের জন্য ব্র্যাকের কাছে পাঠান। ফলে উন্নয়ন সংস্থাগুলো এক ধরনের ভূমিকা রাখছে। সরকার নিয়ন্ত্রণমূলক মানসিকতা না নিয়ে, তাদের ওপর আস্থা রেখে কাজে লাগালে নিঃসন্দেহে আরও ভালো উদাহরণ তৈরি হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের পরিবর্তনে বেসরকারি খাতেরও ব্যাপক অবদান। এ ক্ষেত্রে ব্র্যাক রয়েছে অগ্রগামী ভূমিকায়।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

হোসেন জিল্লুর রহমান: আপনাকেও ধন্যবাদ।

সমকালে প্রকাশ: ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।