Mahfuzur Rahman Manik
ভারতে স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষয়কাল
জানুয়ারী 19, 2023

লেখক: সমদীপ সেন
অনুবাদক: মাহফুজুর রহমান মানিক

ভারতের জনপ্রিয় টেলিভিশন সাংবাদিক রবিশ কুমার দেশটির সবচেয়ে পুরোনো বেসরকারি চ্যানেল নিউ দিল্লি টেলিভিশন লিমিটেড এনডিটিভি থেকে নভেম্বরের শেষে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তাঁর পদত্যাগ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ধ্বংসের অনুস্মারক। তাঁর পদত্যাগ সাধারণ কোনো বিষয় ছিল না। কুমার দুই যুগের অধিক সময় ধরে এনডিটিভির জনপ্রিয় কণ্ঠ ছিলেন। ভয়-ডরহীন, কঠিন প্রতিবেদন সরাসরি উপস্থাপন ও ক্ষমতাসীনদের চ্যালেঞ্জ করার জন্য তিনি পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের পক্ষ নিয়ে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতায় ইন্ধন দেওয়ার জন্য সম্প্রতি তিনি অন্য সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা করেন।

এনডিটিভির অধিকাংশ শেয়ার কেনার মাধ্যমে চ্যানেলটির মালিকানায় যখন বিশ্বের তৃতীয় ধনী গৌতম আদানি আসেন, তখনই রবিশ কুমার পদত্যাগে বাধ্য হন। আদানিকে নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় মোদি আদানির বিমান ব্যবহার করেন। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসেন। এর পর থেকে এ পর্যন্ত আদানির সম্পদ ৭ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১১০ বিলিয়ন ডলার হয়।

আদানি যদিও তাঁর মালিকানায় এনডিটিভির স্বাধীনতা বজায় রাখা এবং সরকার যখন ভুল করে তার সমালোচনার কথা বলেছেন; মোদি সরকারকে চ্যালেঞ্জকারী এমন একটি চ্যানেলে আদানির মালিকানা গ্রহণে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে- এমন মিডিয়া হাউসের মালিকানা কোনো প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর হাতে পড়লে বাকস্বাধীনতার সুরক্ষা কীভাবে সম্ভব?

কিংবা কুমার যেমনটা বলেছেন, 'কীভাবে একটি চ্যানেল সরকারের সমালোচনা করবে, যে চ্যানেলটি এমন এক প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়; সরকারের আনুকূল্যে যাদের ব্যবসায়িক সাফল্য এসেছে। ফলে আমার কাছে এটা পরিস্কার- আমাকে পদত্যাগ করতে হবে।'

এই সমস্যা যে শুধু ভারতেই রয়েছে, এমনটি নয়। মিডিয়ায় করপোরেটদের একচেটিয়া প্রভাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাড়বাড়ন্ত। ২০১৭ সালে বার্নি স্যান্ডার্স লিখেছিলেন কীভাবে কমকাস্ট, নিউজ কর্প, ডিজনি, ভায়াকম, টাইম ওয়ার্নার ও সিবিএস- মাত্র ছয়টি কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের ৯০ শতাংশ মিডিয়ার মালিক। ২০১৬ সালে ফোর্বস লিখেছে, ১৫ বিলিয়নপতি সেখানকার সব প্রধান জাতীয় সংবাদমাধ্যমের মালিক, যার মধ্য রয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং ওয়াশিংটন পোস্ট।

যুক্তরাজ্যে মিডিয়া রিফর্ম কোয়ালিশন বর্ণনা করেছে, যে কোনো আধুনিক গণতন্ত্রের সংকট হলো, মিডিয়ার মালিকানা সংকুচিত করা। ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যের ৭১ শতাংশ জাতীয় পত্রিকার বাজার তিনটি কোম্পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এরা হলো- নিউজ ইউকে, ডেইলি মেইল গ্রুপ ও রিচ। ২০১৯ সালের মধ্যে এ কোম্পানিগুলোর মার্কেট শেয়ার বেড়ে ৮৩ শতাংশ হয় এবং ২০২১ সালে তা ৯০ শতাংশে উঠে আসে।

মিডিয়ায় আধিপত্য কমানোর জন্য কিছু দেশে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জার্মানিতে একক কোনো কোম্পানি ৩০ শতাংশের বেশি টিভি শ্রোতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু ইউরোপজুড়ে পরিস্থিতির ভিন্নতাও রয়েছে। ইতালিতে আর্থিক কোম্পানি ফিনিভেস্ট নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বেরলুসকুনির পরিবার। আর এ কোম্পানিটিই দেশটির প্রধান তিনটি টিভি চ্যানেলের মালিক। এমনকি ইতালির সংবাদপত্র ও বই প্রকাশের সবচেয়ে বড় প্রকাশকও এ কোম্পানি।

নব্বইয়ের দশক থেকে ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়ারও প্রসার ঘটে। এ শিল্পের বাজার ২০২১ সালের ২১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৬ সালে ৫৪ বিলিয়ন ডলার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতে এখন লক্ষাধিক সংবাদপত্র ও ৩৮০টি নিউজ চ্যানেল রয়েছে। এর সঙ্গে ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের কারণে ভারতীয়দের হাতে বিভিন্ন ধরনের সংবাদমাধ্যম রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের মতো ভারতীয় মিডিয়াও কিছু গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রথম সতর্ক ঘণ্টা বেজেছিল ১০ বছর আগে যখন রাজস্বের দিক থেকে ভারতের সবচেয়ে বড় কোম্পানি রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ মিডিয়া খাতে প্রবেশ করে। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে মুকেশ আম্বানির (বর্তমানে বিশ্বের অষ্টম ধনী) নেতৃত্বাধীন রিলায়েন্স কোম্পানি ঋণগ্রস্ত নেটওয়ার্ক ১৮ মিডিয়া গ্রুপে বিনিয়োগ করেছিল। ফলে ভারতের সবচেয়ে বড় মিডিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, যাদের একসঙ্গে ইংরেজিতে সাধারণ চ্যানেল ও বিজনেস চ্যানেল তৈরি হয়। হিন্দি ও অনেক আঞ্চলিক ভাষায়ও চ্যানেল হয়। ফলে সে সময় একটি কোম্পানি তথা রিলায়েন্সের মিডিয়া কাভারেজের প্রভাব কেমন পড়বে, তা নিয়ে সাংবাদিক ও বিশ্নেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কারণ তাতে কোম্পানিটির সিদ্ধান্তে ভারতের অর্থনীতির ওপরেও প্রভাব ছিল। ২০১৪ সালে রিলায়েন্স নেটওয়ার্ক এইটিন এর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেয়। তবে মালিকানা বদল স্বস্তির ছিল না। কোম্পানির মালিকানাধীন সবচেয়ে বড় চ্যানেল সিএনএন-আইবিএনের এডিটর-ইন-চিফ রাজদীপ সরদেশাই তখন পদত্যাগ করেন। তাঁর বিদায়ী ই-মেইলে তিনি লিখেছিলেন, সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ও সততার সঙ্গে আমি ২৬ বছর সাংবাদিকতা করে আসছি। আমি এত পুরোনো যে, সে নীতিতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম নই!

এখন বড় ব্যবসা, রাজনীতি ও ভারতীয় মিডিয়ার মেলবন্ধন মানে যে কোনো কোম্পানির চেয়েও ক্ষমতাবান। জি-মিডিয়া করপোরেশন আরেকটি প্রভাবশালী টিভি নেটওয়ার্ক। এটি এসেল গ্রুপের অংশ, যার নেতৃত্বে রয়েছেন সুভাষ চন্দ্র, যিনি ভারতের উচ্চকক্ষের সাবেক সদস্য। তিনি নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির সমর্থন পেয়েছেন। ২০১৯ সালে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের প্রতিবেদনে এমন আনেক উদাহরণ রয়েছে। ওদিশা টিভির মালিকানায় রয়েছে বৈজয়ন্ত পান্ডার পরিবার, যিনি বিজেপির সহসভাপতি ও মুখপাত্র। উত্তর-পূর্ব ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় চ্যানেল নিউজ লাইভের মালিকানায় রয়েছেন রিনিকি ভুয়ান শর্মা, যিনি আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নেতা হেমন্ত বিশ্ব শর্মার স্ত্রী।

সংবাদমাধ্যম, অর্থ ও রাজনীতির এই মেলবন্ধনকে রবিশ কুমার একটি পরিভাষা দিয়েছেন- গদি মিডিয়া। গদি মিডিয়া মানে প্রতিষ্ঠিত অনেকের মুখপাত্র, নরেন্দ্র মোদির শাসনামল যাদের জন্ম দিয়েছে। যখন বিজেপির নেতৃত্বে মুসলমানদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় কিংবা ২০২১ সালে বিজেপি যখন কৃষকদের আন্দোলনের সমালোচনা করেছিল তখন ভারতীয় মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সেটি যেভাবে এসেছিল, সেটিই প্রমাণ করে- রবিশ কুমারের পরিভাষার বাইরে যাওয়া কঠিন।

এদিকে সাংবাদিক ও সরকারের সমালোচকদের ওপর আক্রমণের কারণে ভারত ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম সূচকে আরও পিছিয়ে যাচ্ছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৫০-এ। তবে আশার বিষয় হলো, সময় এক রকম থাকে না। হ্যাঁ, ভালো সাংবাদিকতার জন্য অর্থের প্রয়োজন রয়েছে বটে। একই সঙ্গে স্বাধীনতাও জরুরি। যদি 'মিডিয়া মনোপলি' রবিশ কুমারের মতো সাংবাদিকদের পদত্যাগে বাধ্য করে, সেটি ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য কখনও ভালো হতে পারে না।

সমদীপ সেন: সহযোগী অধ্যাপক, ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, রসকিলড ইউনিভার্সিটি, ডেনমার্ক; আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর

সমকালে প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।