Mahfuzur Rahman Manik
প্রণোদনার বীজে সর্বনাশ!
জানুয়ারী 27, 2023

কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ সহায়তা দেয়, যাতে সঠিক বীজ ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন বাড়ে। অথচ এবার সেই বীজে সর্বনাশ দেখছেন কৃষক। মঙ্গলবার সমকালে প্রকাশিত খবর অনুসারে, দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষকরা কৃষি বিভাগ থেকে পাওয়া পেঁয়াজ ও সরিষার বীজ রোপণ করে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। কোথাও পেঁয়াজের চারা মরে গেছে; কোথাও সরিষার বীজ থেকে চারাই গজায়নি। প্রণোদনার চারা নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাষিদের আনন্দ পরিণত হয়েছে বেদনায়।
সমকালের হিসাব বলছে, এবার ৬৪ জেলার ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ কৃষক এ সুবিধা পান এবং এ বাবদ সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮১ কোটি টাকা। সংশ্নিষ্ট প্রতিবেদনে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কৃষক তরিকুলের কথা উঠে এসেছে। তিনি দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চাষ করেছিলেন। কৃষি বিভাগ থেকে তাঁকে এক কেজি বীজ সহায়তা দেওয়া হয়। তিনি পেঁয়াজ বিক্রি করে ভালো আয়ের প্রত্যাশা করেছিলেন; অথচ বীজতলা থেকে জমিতে রোপণের পর পেঁয়াজের গাছ শুকিয়ে যেতে শুরু করে এবং তাঁর জমির সব পেঁয়াজের চারা মরে গেছে।
তরিকুলের মতো যেসব কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের কী হবে? কৃষকরা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের যে বীজ দেওয়া হয়েছে, তাতে ভেজাল আছে। না হলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। এটা সত্যিই বিস্ময়কর। যে বীজ-চারা বেশি ফলনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে সেখানে এমন উল্টো ফল হওয়ার কারণ খুঁজে বের করা জরুরি।

আমাদের মনে আছে, মাঝখানে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হওয়ার পর এখানে এ খাদ্যশস্যের কেজি ৩০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এর পর দেশীয়ভাবে পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। মাঠ পর্যায়েও পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার তাগিদ সৃষ্টি হয়। সে জন্যই পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে চাষিদের উৎসাহ দিতে নানা সহায়তার কথা বলে সরকার। সরকারের পক্ষে বীজ, উপকরণ ও প্রযুক্তি সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন কৃষিমন্ত্রী। তারই আলোকে আমরা দেখছি, কৃষকরা পেঁয়াজের বীজ পেয়ে আসছেন। শুধু পেঁয়াজ নয়, সরিষা, ভুট্টা ও অন্যান্য শস্যেরও বীজ কৃষকরা পেয়ে আসছেন। কিন্তু সেই বীজ কিংবা চারার ব্যবহারে কৃষক লাভবান না হয়ে যদি ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাহলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হবে না।

এবার একযোগে যে অঘটন ঘটল, এটা কোনো স্বাভাবিক বিষয় হতে পারে না। এটা স্পষ্ট, প্রশাসন বিষয়টিতে শুরু থেকেই উদাসীন। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন-বিএডিসি কিংবা কৃষি কর্মকর্তা- যেভাবেই বীজ বা চারা কৃষকের কাছে পৌঁছানো হোক, সব কিছুর আগে এটা নিশ্চিত হওয়া দরকার যে, ওই বীজ যথাযথ কিনা। এর মাধ্যমে ফলন কেমন হবে এবং তাতে কৃষক ও দেশ কতটা উপকৃত হবে। তা নিশ্চিত না হয়ে কোনো বীজ কৃষকের কাছে পৌঁছাবে কেন? সমকালের প্রতিবেদকের কাছে কৃষকরা অভিযোগ করেছেন, বীজ দেওয়ার পর দুই সপ্তাহ পার হলেও কৃষি কর্মকর্তা খোঁজ নেননি? এর অর্থ দাঁড়ায়, তাঁরা কোনোরকমে কৃষককে বীজ দিয়েই দায় সারতে চাইছেন। কিন্তু তাঁদের কাজ যে শুধু বীজ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা দেওয়ার পর কৃষক কীভাবে জমিতে লাগাচ্ছেন বা রোপণ করছেন এবং রোপণ করার পর নিয়মিত পরিচর্যার বিষয়ে তার হালনাগাদ তথ্য জানা আবশ্যক।
এমনও অভিযোগ রয়েছে, কৃষককে যে বীজ দেওয়া হয়, তা মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ভালো বীজ অন্যত্র বিক্রি করে দেওয়া হয়। আবার বেসরকারিভাবে বীজের ব্যবসার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, কৃষকের হাতে ভালো বীজ না পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তাঁদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে; আবার হাইব্রিড বীজ কৃষকদের দেওয়া হয় বলে অনেকেই হয়তো তা লাগানোর নিয়ম জানেন না। সে জন্য ফলনও সেরকম হয় না।

এবার প্রণোদনার বীজে কৃষকের সর্বনাশ হওয়ার কারণ যাই থাকুক, তা খতিয়ে দেখা দরকার। বলার অপেক্ষা রাখে না, কৃষি আমাদের ভরসার বড় জায়গা। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কৃষক নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। অথচ নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরাই। সরকারি বীজও যদি কৃষকের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ হয়, তা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক।

সমকালে প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৩

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।