দেশের অনেক শিশুই যেখানে অপুষ্টিতে ভুগছে, সেখানে উপকূলীয় শিশুদের অপুষ্টি কতটা মারাত্মক হতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উপকূলের ১৪টি জেলায় শিশুর অপুষ্টির হার যে বেশি, তা ইতোমধ্যে গবেষণায়ও উঠে এসেছে। উপকূলের মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বিপর্যস্ত। সেখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা যখন সংকটের মুখে, স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খেতে না পারায় উপকূলের শিশুরা অপুষ্টিসহ দীর্ঘমেয়াদে নানা সমস্যায় আক্রান্ত। উপকূলের শিশুদের রক্ষায় তাই পরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সমাজসেবী সংস্থাগুলো কাজ করতে পারে। শুক্রবারের সমকালের প্রতিবেদন অনুসারে, উপকূলীয় অঞ্চলে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের অপুষ্টি দূর করতে যৌথভাবে দুটি বেসরকারি সংস্থা রাইট টু গ্রো কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশ ও সিভিল সোসাইটি অ্যালায়েন্স ফর স্কেলিং আপ নিউট্রিশন আগামী পাঁচ বছর যৌথভাবে কাজ করবে। উপকূলের মধ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা, বরগুনা ও পটুয়াখালীর প্রান্তিক শিশুদের অপুষ্টির হার খুব বেশি বলে সেখানে খর্বকায় শিশুর সংখ্যাও বাড়ছে। প্রতিষ্ঠান দুটি তাই সেখানে বিশেষভাবে কাজ করবে।
উপকূলের মানুষের জীবন সংগ্রামে তাদের শিশুরাও অন্তর্ভুক্ত। নদীভাঙন আর ঘূর্ণিঝড়ে সেখানে বসতবাড়ি সুরক্ষাও অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। সমুদ্রপাড়ের মানুষ অধিকাংশেরই জীবিকার প্রধান উৎস মাছ ধরা। সে জন্য উপকূলের অনেক শিশু অজান্তেই মৎস্যজীবী হিসেবে গড়ে ওঠে। উপকূলে শিশুশ্রম অপ্রতিরোধ্য। শৈশব থেকেই তাদের কর্মজীবন শুরু হয় বলে সেখানে নিরক্ষরতার হারও বেশি। সার্বিকভাবে উপকূলে সাক্ষরতার হার তাই কম। উপকূলের অনেক এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও পর্যাপ্ত নেই। কোথাও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান কিংবা বেসরকারি সংস্থাগুলো শিক্ষাসেবা দিলেও সব এলাকায় যথেষ্টসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। উপকূলে শিক্ষার হার কম হওয়ায় তার সঙ্গে অপুষ্টি বাড়ার সম্পর্কও অস্বীকার করা যাবে না।
শিশুকে সঠিকভাবে লালন-পালনের ক্ষেত্রে বাবা-মা কিংবা পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। মা-বাবার মধ্যে শিক্ষা কম থাকলে শিশুর গুরুত্ব অনুধাবন করা কঠিন। পারিবারিক সচেতনতা শিশুর ভালোভাবে বেড়ে ওঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উপকূলের কঠিন বাস্তবতায় দারিদ্র্যের কশাঘাতে বিপর্যস্ত পরিবারগুলো হয়তো সেদিকে মনোযোগ দিতে পারে না; কারণ অন্নের সংস্থানই সেখানে হুমকির মুখে। পুষ্টির চিন্তা তখনই সম্ভব যখন পরিবারের সব সদস্যের তিনবেলা খাবার নিয়ে টানাটানি থাকে না। উপকূলের যে গর্ভধারিণী ঠিকভাবে খেতে পায় না, সে মায়ের সন্তান অপুষ্টি নিয়েই জন্মাবে। অপুষ্টি নিয়ে জন্মানো শিশু পরবর্তী সময়ে একইভাবে খাদ্য সংকটের মধ্যে বড় হলে তাকে অপুষ্টির বেড়াজালেই আবদ্ধ থাকতে হয়। কিন্তু উপকূলে সম্পদের অভাব রয়েছে- এটা বলা যাবে না। সেখানে জাল ফেললে যদি মাছ ওঠে; মাঠে যদি ফসল হয় তবে শিশুরা অপুষ্টির শিকার কেন হবে- সে প্রশ্নটিও সংগত। বস্তুত সে জন্যই আসে সচেতনতার বিষয়টি। গর্ভধারিণীকে স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে বেশি খেতে হলেও অনেক সামাজিক কুসংস্কারের কারণে সেভাবে খেতে পারে না। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো এবং ছয় মাস বয়সের পর থেকে পরিবারের সঙ্গে স্বাভাবিক সব খাবারে অভ্যস্ত করলে শিশুর বিশেষ খাবারেরও প্রয়োজন হয় না। সে জন্য উপকূলের শিশুর অপুষ্টি নিরসনের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়েও মনোযোগী হওয়া দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সেখানে ঘূর্ণিঝড় বাড়ছে। অনেক এলাকায় সমুদ্রের পানি এসে লবণাক্ততা সংকট তৈরি করছে। এ কারণে খাবারের পানির সমস্যা তো রয়েছেই, জমিতেও ফসল হয় না। লবণাক্ততাসহিষ্ণু ফসল হলে খাবারের সংকট কিছুটা হলেও কাটবে। উপকূলে যেসব পরিবারে আয়-রোজগারের সমস্যা আছে তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় এনে অন্তত খাদ্যের অভাব মোচন করা চাই। উপকূলীয় এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি করে সেখানে শিশুর ভর্তি নিশ্চিত করা এবং মিড-ডে মিলের মাধ্যমে তাদের পুষ্টিচাহিদা পূরণ কিছুটা হলেও সম্ভব হবে। অপুষ্টির শিকার শিশু আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার পেছনেও বড় বাধা। সে জন্য উপকূলের শিশুদের প্রাধান্য দিয়ে দেশ থেকে অপুষ্টি দূর করতে জাতীয় পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।