সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক ড. মোহা. কামরুল হাছান
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মাহফুজুর রহমান মানিক
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) হর্টিকালচার বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহা. কামরুল হাছান জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা- এফএওসহ উল্লেখযোগ্য দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৮ সালে তিনি অস্ট্র্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড, সেন্ট লুসিয়া থেকে পোস্ট ডক্টরেট এবং ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড, গ্যাটন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার জেমস কুক ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স ডিগ্রি অর্জনের আগে তিনি বাকৃবি থেকে ১৯৯৬ সালে বিএস-সিএজি ও ১৯৯৮ সালে এমএস ইন হর্টিকালচার ডিগ্রি অর্জন করেন। মোহা. কামরুল হাছান ১৯৭০ সালে চুয়াডাঙ্গায় জন্মগ্রহণ করেন।
সমকাল: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবসে। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য- কাউকে পেছনে ফেলা নয়। একে যদি আমরা খাদ্য অপচয়ের নিরিখে দেখি, তার ব্যাখ্যা কী?
মোহা. কামরুল হাছান: এবারের খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যে বলা হয়েছে, লিভ নো ওয়ান বিহাইন্ড অর্থাৎ কাউকে পেছনে না রাখা। আমরা জানি, অনেক মানুষ চাহিদা অনুসারে খেতে পারে না। অন্যদিকে আমরা অনেকে ব্যাপক খাবার অপচয় করি। আমরা খাবারের উপযুক্ত ব্যবহার করলে নিশ্চয়ই তা অন্যরা পেত। তা ছাড়া পেছনে থাকা মানুষদের কাছেও অপচয় করা খাবারটি পৌঁছানো যায়।
সমকাল: গত বছর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা- এফএও পরিচালিত গবেষণায় দুই ধরনের অপচয়ের কথা বলা হয়েছে। আপনি ওই গবেষণা দলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। গবেষণায় আপনারা কী পেয়েছেন?
কামরুল হাছান: আমাদের খাবার দু'ভাবে অপচয় হয়। একটাকে আমরা বলছি ফুড লস। আরেকটা ফুড ওয়েস্ট। ফুড লস হলো, কৃষকের ক্ষেত থেকে শুরু করে পরিবহন হয়ে বাজার পর্যন্ত পৌঁছতে যত ক্ষতি হয়। আর ফুড ওয়েস্ট হলো, খাবার টেবিলে যেটি অপচয় হয়।
সমকাল: আমাদের 'ফুড লস' বা খাদ্য নষ্ট কেমন হয়?
কামরুল হাছান: আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ১২ থেকে ৩২ শতাংশ খাদ্য আগেই নষ্ট হয়ে যায়। নির্দিষ্টভাবে যদি বলি, ধান উৎপাদনের পর কৃষকদের থেকে বাজার পর্যন্ত যেতে মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগী, পরিবহন, গুদামজাতকরণ ইত্যাদিতে প্রায় ১৮ শতাংশ অপচয় হয়। গমে নষ্ট হয় সাড়ে ১৭ শতাংশ। আবার আম, কলা, আলু, গাজর, টমেটোসহ শাকসবজিতে অপচয়ের হারও ১৭ থেকে ৩২ শতাংশ। এমনিভাবে দুধ, ডিম, মাছ, মাংসও নষ্ট হচ্ছে। তবে এখন আধুনিক নানা প্রযুক্তির ব্যবহার ও সচেতনতা বাড়ার কারণে নষ্ট হওয়া কিছুটা কমেছে। ২০১০ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, ফল ও সবজির ক্ষেত্রে তখন অপচয়ের হার ছিল ২২-৪৪ শতাংশ।
সমকাল: আর 'ফুড ওয়েস্ট' বা খাবার অপচয়?
কামরুল হাছান: জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা- ইউনেপ ২০২১ সালে ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স নামে রিপোর্ট প্রকাশ করে। তারা দেখিয়েছে বাংলাদেশে বছরে এক কোটি ৬ লাখ টন খাদ্য অপচয় হয়। আমাদের গবেষণায় এসেছে, ধনী পরিবার এবং কিছু মধ্যবিত্ত পরিবারে প্রতি সপ্তাহে দুই কেজি খাবার অপচয় হয়। কিন্তু আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে; সেটি হলো, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র ৬০ শতাংশ পরিবারে কোনো খাবারই অপচয় হয় না।
সমকাল: দুই ক্ষেত্রেই আমরা যে খাদ্য অপচয় দেখছি, তা কি রোধ করা যায় না?
কামরুল হাছান: পচনশীল খাদ্য কিংবা ফল ও সবজি পরিবহনের ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বে 'রেফ্রিজারেটেড ভেহিক্যাল' বা বলা যায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে। সেগুলো আমাদেরও প্রয়োজন। তা ছাড়া খাদ্যপণ্য সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত 'কোল্ডস্টোরেজ' প্রয়োজন। আবার অনেক ফল ও সবজি প্রক্রিয়াজাত করে দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা যায়।
সমকাল: খাবার অপচয় রোধে নাগরিক সচেতনতা কতটা জরুরি?
কামরুল হাছান: ফুড ওয়েস্ট বা টেবিলে খাবার অপচয় রোধে সচেতনতাই সবার আগে জরুরি। আপনি কতটুকু খাবেন ঠিক সে পরিমাণ খাবার নিন। পরিমাণমতো রান্না করুন। বাড়ি, অনুষ্ঠান কিংবা রেস্টুরেন্ট যেখানেই যান, খাবারের ক্ষেত্রে একই নীতি মানলে অপচয় হওয়ার কথা নয়। চিন্তা করে দেখুন, যে চাল ভাত হিসেবে আমরা খাচ্ছি, সেটা প্রস্তুত হতে কতটা পথ ঘুরে এসেছে। এর পেছনে কৃষকের কতটা ঘাম ঝরেছে। আবার যে খাবার আমরা ফেলে দিচ্ছি, সেটাই ভুখা মানুষ খেতে পারছে না- এসব চিন্তা করলে খাবার অপচয়ের প্রশ্নই আসে না।
সমকাল: এ ক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টির উপায় কী?
কামরুল হাছান: খাদ্য অপচয় রোধে নানাভাবে জনসচেতনতা তৈরি করা সম্ভব। প্রথমত, পারিবারিক সচেতনতা জরুরি। পরিবারের একজন সদস্যও যদি এ ব্যাপারে সতর্ক থাকে, অন্যরাও তার থেকে শিখতে পারে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কিংবা কারিকুলামে খাদ্য অপচয়ের কুফল তুলে ধরা যায়। তৃতীয়ত, নাগরিক সমাজ এ নিয়ে কাজ করতে পারে। র্যালি বা এ জাতীয় কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে। চতুর্থত, রেস্টুুরেন্ট বা কমিউনিটি সেন্টারে খাবার অপচয় যাতে না হয়, সে জন্য নির্দেশিকা থাকা দরকার। এমনকি এসব জায়গায় যদি লেখা থাকে- 'আমরা খাবার অপচয় করি না', তাতেও অনেকে অনুধাবনের চেষ্টা করবে। সর্বশেষ, গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক কার্যক্রমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম।
সমকাল: খাদ্য অপচয় রোধে প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা কি হতে পারে?
কামরুল হাছান: ফসল নষ্ট রোধে আধুনিক প্রযুক্তি আনার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। তা ছাড়া খাবার অপচয় রোধ এবং অতিরিক্ত খাবারের ব্যাপারেও কৌশল থাকা দরকার। বিশ্বের অনেক দেশেই 'ন্যাশনাল ফুড লস রিডাকশন স্ট্র্র্যাটেজি' বা জাতীয় খাদ্য অপচয় রোধে কৌশল বা নীতি রয়েছে। বর্তমানে জাতিসংঘের যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, সেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক খাদ্য অপচয় অর্ধেকে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এ লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশই কৌশলপত্র গ্রহণ করেছে। তারা ফুড লস ও ফুড ওয়েস্ট দুটোতেই নজর দিচ্ছে সমানভাবে। খাদ্য অপচয় রোধে আমাদের সরকারেরও জাতীয়ভাবে এমন কৌশল নির্ধারণ করা জরুরি। তাতে রেস্টুুরেন্ট, কমিউনিটি সেন্টারের জন্য যেমন নির্দেশনা থাকবে, তেমনি ব্যক্তিগত অপচয় রোধেও ব্যবস্থা থাকবে।
সমকাল: সচেষ্ট ও সচেতন থাকার পরও যদি খাবার অপচয় হয়?
কামরুল হাছান: এ ক্ষেত্রে অপচয়কৃত খাবার কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটা দেখা জরুরি। অন্যান্য দেশে যেমনটা রয়েছে, রেস্টুুরেন্টের উদ্বৃত্ত খাবার অভাবীদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়। আমরাও সেটি করতে পারি। উদ্বৃত্ত খাবার ফেলে না দিয়ে তা প্রসেস করে অসহায়দের দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বাড়ির খাবারগুলো আশপাশের মানুষকে দেওয়া যায়। অনেকে হাঁস-মুরগি লালন-পালন করেন, তাঁদেরও দেওয়া যায়। কিন্তু শহরে আমরা দেখছি ডাস্টবিনের অধিকাংশজুড়েই থাকে অপচয় হওয়া খাবার। খাবারের এ বর্জ্য কীভাবে পুনরুৎপাদন করে সার বা অন্য কাজে ব্যবহার করা যায়, সে জন্য আমাদের গবেষণাও জরুরি।
সমকাল: বিশ্বে একটা সংকট স্পষ্ট। এর মধ্যে এফএও বাংলাদেশে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করছে। সে জন্য উৎপাদনের পাশাপাশি খাদ্য অপচয় রোধও গুরুত্বপূর্ণ নয় কি?
কামরুল হাছান: খাদ্য সংকটের শঙ্কা রয়েছে বিশ্বব্যাপীই। এফএও এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে বেশি সংকটের কথা বলছে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং সংকট মোকাবিলার একটা কৌশল হওয়া উচিত অপচয় বন্ধ করা। অপচয় করলে সংকট আরও ত্বরান্বিত হবে। আমরা একটা প্রবাদ জানি- 'অপচয় করো না, অভাব হবে না।' বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবিলায় নিজেদের দায়িত্বশীল ভূমিকার জন্য এবং জাতীয় সমৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত সচ্ছলতা নিশ্চিতেও খাদ্য অপচয় রোধ করতেই হবে।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
কামরুল হাছান: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।