বিবিসি বাংলা রেডিওর সম্প্রচার ৮১ বছর পর বন্ধ হওয়ার খবরে চমক থাকলেও আশ্চর্য হওয়ার সুযোগ সামান্যই। বিশ্বব্যাপী সংবাদমাধ্যমের নতুন যে বিবর্তন ঘটছে, সেখানে অনেক বিশ্ববিখ্যাত সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। সংকুচিত হয়েছে নানা ভাষার রেডিও কার্যক্রম। এখন বিবিসি তার ১০টি ভাষার রেডিও সম্প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে কোনো ভাষা-বিভাগই পুরোপুরি বন্ধ করা হচ্ছে না। তারা অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনা করবে। বিবিসি যদিও কারণ হিসেবে ব্যয় সংকোচনের বিষয়টি সামনে আনছে, তবে এটা অস্বীকারের উপায় নেই- রেডিওর শ্রোতা কমছে। ২০১৮ সালে বিবিসির খবরেই আমরা জানতে পারি, বাংলাদেশে যেখানে ৮১ শতাংশ মানুষ টেলিভিশন দেখে; সেখানে রেডিও শোনে মাত্র ১৫ শতাংশ। বস্তুত ২০১৮ সালেই বিবিসি বাংলার রেডিও কার্যক্রম সংকুচিত হয়েছিল। তখন বিবিসি বাংলার নিয়মিত চারটি অনুষ্ঠান থেকে দুটি বাদ দেওয়া হয়। এখন বিবিসি বাংলা দুটি রেডিও অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে।
বিবিসি বাংলা রেডিও বন্ধের বিষয়টি অনেকের জন্যই মন খারাপ করা খবর। বিবিসির সঙ্গে আমাদের অনেকেরই দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। ১৯৪১ সাল থেকে বাংলায় সম্প্রচার শুরু হওয়া বিবিসি রেডিওর পূর্ণাঙ্গতা পায় ১৯৬৫ সালে। বিশ্বস্ত সংবাদ পরিবেশনা এবং সংবাদ বৈচিত্র্যের কারণে অনেকেই রুটিন করে বিবিসির সংবাদ শোনেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই বাংলাভাষী মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে বিবিসি বাংলা। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনের খবর যেমন বিবিসি বাংলা রেডিওতে শোনা যেত; তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্ভরযোগ্য খবরের জন্য বিবিসি বাংলা রেডিওই ছিল ভরসা। আমরা বিবিসি বাজারের গল্প জানি। পাবনার ঈশ্বরদীতে কাশেম মোল্লার দোকানে স্বাধীনতা যুদ্ধের খবর রেডিওতে শুনতে মানুষ হাজির হতো। বিবিসিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যগাথা মানুষ শুনত। তারই আলোকে জায়গাটির নাম হয়ে যায় বিবিসি বাজার। একাত্তরের বিবিসির সঙ্গে মার্ক টালির নামটিও গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সকাল-সন্ধ্যা বিবিসিতে মার্ক টালি কী বলছেন, তা ছিল অনেকেরই আগ্রহের বিষয়। কারণ স্বাধীনতা যুদ্ধের হালনাগাদ তথ্য তাঁর কণ্ঠে শোনার জন্য আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করত অনেক শ্রোতা।
মুক্তিযুদ্ধের পরও বিবিসি রেডিও বাংলাভাষীদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সিরাজুর রহমান, আতাউস সামাদসহ বিবিসি বাংলার জনপ্রিয় অনেক কণ্ঠ ছিল। বিবিসির আকর্ষণীয়ভাবে সংবাদ উপস্থাপন এবং সংবাদমাধ্যমটির সংবাদদাতা কিংবা উপস্থাপক প্রায় প্রত্যেকেরই আলাদা ধারার পরিবেশনার কারণে শ্রোতা রেডিও খুললেই বলে দিতে পারত- কণ্ঠটি কার। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সংবাদ প্রকাশে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং পক্ষপাতহীন সংবাদ প্রচারের জন্যই বিবিসি বাংলার সংবাদে মানুষের এক ধরনের আস্থা তৈরি হয়। সে জন্য দলমত নির্বিশেষে সবাই বিবিসির খবর শুনে থাকে। বিভিন্ন সময় কর্তৃপক্ষের নানা বিধিনিষেধের কারণে দেশীয় সংবাদমাধ্যমে সব পক্ষের বক্তব্যসংবলিত সংবাদ পাওয়া যেখানে কঠিন; সেখানে বিবিসি শ্রোতাদের সে প্রত্যাশা পূরণ করছে। সে জন্যই এটি বন্ধের খবরে হতাশা ব্যক্ত করেছেন অনেকে। তাই বিষয়টি যেমন সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ খবর হিসেবে এসেছে; তেমনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আলোচিত হয়েছে।
বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, বাংলার পশাপাশি আরবি, ফারসি, চীনা, কিরঘিজ, উজবেক, হিন্দি, ইন্দোনেশিয়ান, তামিল ও উর্দু ভাষার রেডিও সম্প্রচার বন্ধ হবে। আবার লন্ডনে নতুন একটি চীনা ইউনিট চালু করবে; অন্যদিকে কিছু সার্ভিস লন্ডন থেকে সরিয়ে সংশ্নিষ্ট দেশে নিয়ে যাওয়া হবে। যেমন থাই সার্ভিস লন্ডন থেকে ব্যাংককে, কোরিয়ান সার্ভিস সিউলে, বাংলা সার্ভিস ঢাকায় এবং ফোকাস অন আফ্রিকা টিভি বুলেটিন নাইরোবিতে নেওয়া হবে। বিবিসির নতুন সিদ্ধান্তের যুক্তি হিসেবে কর্মী কমিয়ে এর ব্যয় সংকোচনের বিষয় যেমন বলা হয়েছে; তেমনি সংবাদমাধ্যমটি আরও আধুনিক, ডিজিটাল ও সুবিন্যস্ত করার কৌশলকে সমর্থন করতে এ পরিকল্পনা নেওয়ার কথাও জানিয়েছে। বস্তুত সময়ের আলোকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণেই বিবিসির এ সিদ্ধান্ত এসেছে। দিন দিন যেভাবে মানুষের অভ্যাসে পরিবর্তন আসছে; যেভাবে মানুষ অনলাইন, সামাজিক মাধ্যম আর ইউটিউব ভিডিওতে ঝুঁকছে; সংবাদমাধ্যমগুলোও সেভাবে নিজেদের পরিবর্তন করছে। বিবিসি বাংলার রেডিও কার্যক্রম বন্ধ হওয়াও তার বাইরে নয়।