Mahfuzur Rahman Manik
নজরুলকে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি হয়নি বললেই চলে

সাক্ষাৎকার: ড. নাশিদ কামাল
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মাহফুজুর রহমান মানিক

নজরুলসংগীতশিল্পী অধ্যাপক ড. নাশিদ কামাল প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল অব বিজনেসের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের সংযুক্ত অধ্যাপক ছিলেন। ২০১০ সাল থেকে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে বায়োস্ট্যাটিসটিক বিভাগে অধ্যাপনার আগে তিনি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে ১৯৯৬ সাল থেকে বিভাগীয় প্রধানসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে ১৯৮৬ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে শিক্ষকতা করেন। তিনি কনসালট্যান্ট ও গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন ইউএনএফপি ও আইসিডিডিআর,বিতে। নজরুলসংগীতশিল্পী পরিষদের সহসভাপতি নাশিদ কামাল ১৯৯৬ সালে লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনে পিএইচডি করেছেন। তিনি পরিসংখ্যানে কানাডার কার্লটন ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তাঁর লিখিত ও অনুবাদ গ্রন্থসংখ্যা ১৭টি। ২০০৯ সালে নজরুল একাডেমি থেকে নজরুল পুরস্কার ও ২০১৪ সালে নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে নজরুল পদকসহ একাধিক পদক ও পুরস্কারপ্রাপ্ত নাশিদ কামালের জন্ম ১৯৫৮ সালে।

সমকাল: আপনি নজরুলসংগীত চর্চা করছেন। নজরুলগীতির অন্তত ছয়টি অ্যালবাম আপনার রয়েছে। প্রথম অ্যালবামের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
নাশিদ কামাল: প্রথম অ্যালবাম করার ক্ষেত্রে অনেকেরই নানা ধরনের অভিজ্ঞতা থাকে। আমাদের সময় প্রথম সিডি সাধারণত নিজের অর্থায়নেই করতে হতো। তবে আমি সৌভাগ্যবান, বেঙ্গল আমার প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ করে। তার পারিশ্রমিকও আমি পেয়েছিলাম। তার চিত্রায়ণও হয়েছে। 'আঁচল ভরা ফুল' শিরোনামে ওই অ্যালবামের কাজ শুরু হয় ১৯৯৬/৯৭ সালের দিকে। রেকর্ডিংয়ের জন্য আমাদের তখন কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগেও আমি আমার ফুফু সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমানের সঙ্গে কলকাতায় যাই; সংগীতের রেকর্ডিং করি। আমার উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি ওঁদের খুব ভালো লাগে। তখন দেশ পত্রিকায় এ নিয়ে লেখাও হয়। সব মিলিয়ে প্রথম অ্যালবামের অভিজ্ঞতা সুখকরই বলা চলে।
সমকাল: গান রেকর্ডিংয়ের জন্য কলকাতায় কেন?
নাশিদ কামাল: ঢাকায় যে গানের রেকর্ডিং হতো না, তা নয়। তবে কলকাতায় যাওয়ার পেছনে আমি বাড়তি দুটি সুবিধার কথা বলব। প্রথমটি হলো, শিল্পীকে অন্য একটি শহরে নিয়ে যাওয়া মানে তিনি সংসারসহ সব ধরনের ঝঞ্ঝাটমুক্ত হয়ে কেবল রেকর্ডিংয়ে মনোনিবেশ করতে পারেন। দ্বিতীয় বিষয় হলো, ওরা খুব প্রফেশনাল। একেবারে পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করায় রেকর্ডিংও ভালো হয়। আমাদের পরিচালক ছিলেন দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায়। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে অ্যালবামের কাজ করেছিলেন।
সমকাল: আপনি নজরুল গবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম স্যারের নজরুল জীবনীর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। কাদের লক্ষ্য রেখে আপনি কাজটি করেছেন?
নাশিদ কামাল: আমি ২০১০ সালে নজরুলসংগীতের ইংরেজি অনুবাদ করি 'দ্য রিটার্ন অব লাইলি' নামে। ইংরেজিতেও অন্তমিল রেখে আমি অনুবাদ করেছি। এ বইটির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ছিলেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। তাঁকে আমি মামা ডাকতাম। তিনি তখন তাঁর লিখিত 'নজরুল জীবনী' দিয়ে বললেন, আমি যেন তার ইংরেজি অনুবাদ করি। আমি তখনই কাজটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করি। একাডেমিক ব্যস্ততা ও অন্যান্য কাজের পাশাপাশি অনুবাদটি সম্পন্ন করতে আমার প্রায় তিন বছর লেগে যায়। ১৮টি অধ্যায় সংবলিত নজরুল জীবনী 'বায়োগ্রাফি অব কাজী নজরুল ইসলাম' নামে ২০১৩ সালে নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত হয়। একটা তো হলো, কাজটি মামার অনুরোধে করা। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারও রয়েছে।
সমকাল: কী ব্যাপার?
নাশিদ কামাল: সেটা হলো, কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমার দাদা শিল্পী আব্বাসউদ্দীন সূত্রে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। একেবারে ছোটবেলা থেকেই আমার নজরুলচর্চার সূচনা। আমার নজরুলচর্চার কারণেই বলা চলে দেশ-বিদেশের অনেকেই আমার কাছ থেকে নজরুল সম্পর্কে জানতে চাইত। বিশেষ করে আমি যখন পড়াশোনার জন্য বিদেশে ছিলাম, আমি দেখতাম আমাদের বন্ধুবান্ধবদের সন্তান, যারা বাংলা জানত না, অন্তত তাদের কাছে নজরুলকে পৌঁছাতে হলে ইংরেজি অনুবাদ প্রয়োজন। আমরা জানি, সারাবিশ্বে বাঙালি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। প্রথমত, তাঁদের কাছে এবং নির্বিশেষে বিশ্বে নজরুলকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই আমি 'বায়োগ্রাফি অব কাজী নজরুল ইসলাম' অনুবাদে উৎসাহিত হই।
সমকাল: নজরুল সাহিত্যও অনুবাদের কাজ করেছেন আপনি। সেগুলোর সাড়া কেমন পেয়েছেন?
নাশিদ কামাল: নজরুল জীবনী ও নজরুল সাহিত্য উভয় অনুবাদেই আমি আশানুরূপ সাড়া পেয়েছি। আমার মনে আছে, ২০১৩ সালে যখন নজরুল জীবনীর কাজ শেষ হয়, ওই বছর কলকাতা বইমেলায় অন্তত ৫০ কপি বই বিক্রি হয়। প্রকাশনা-সংশ্নিষ্টরা আমাকে বলেছেন, অন্য বই বিক্রি কম হলেও এই বইটিতে সাড়া পেয়েছেন। কলকাতায় আমি একবার সাদামাটাভাবে হাঁটছি। একজন আমাকে দেখে বললেন, আপনি নাশিদ কামাল না? আপনার বই আমি পড়েছি। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাঙালি বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। তাঁদের কাছে আমার বইগুলো পৌঁছেছে এবং আবাঙালি নয় এমন নজরুল গবেষকও আমার অনুবাদ পড়ছেন।
সমকাল: কাজী নজরুল ইসলামের ওপর সম্প্রতি কী কাজ করেছেন?
নাশিদ কামাল: ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আমার অনুবাদে নজরুলের নির্বাচিত ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। 'সিলেক্টেড শর্ট স্টোরিজ অব কাজী নজরুল ইসলাম' শিরোনামে গ্রন্থটি প্রকাশ হয় ইউরোপীয় প্রকাশনা সংস্থা 'অ্যালাইভা প্রেস' থেকে।
সমকাল: আপনি পেশাগত দিক থেকে গবেষণা ও শিক্ষকতায় রয়েছেন। পাশাপাশি আপনি পুরোদস্তুর সংগীতশিল্পী ও নিমগ্ন সাহিত্যিক। দুটো জগৎ একত্রে কীভাবে সামলে নিয়েছেন?
নাশিদ কামাল: আমার সামনে পারিবারিক যেসব উদাহরণ আমরা দেখছি, সবারই বড় বড় অর্জন রয়েছে। আমার দাদা শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ, বাবা বিচারপতি মুস্তাফা কামাল, মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হোসনে আরা কামাল, চাচা মুস্তাফা জামান আব্বাসী, মামা অর্থনীতিবিদ আনিসুর রহমান। তাঁদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। আমি সময় নষ্ট করিনি। প্রতিটি সময়কে যথাযথ এবং পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমেই এটা সম্ভব হয়েছে।
সমকাল: আপনি নজরুল অনুবাদ করেছেন অবশ্যই। তারপরও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশের তুলনায় বাংলা ভাষার বাইরে কাজী নজরুল ইসলাম কি কম পৌঁছেছে?
নাশিদ কামাল: অবাঙালি বা বাংলা ভাষার বাইরে নজরুল অবশ্যই সে অর্থে কম পৌঁছেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশের চর্চা আমরা দেখেছি। রবীন্দ্রনাথ নিজে খুব গোছানো মানুষ ছিলেন। তাঁর সময়কালেই তাঁর রচনার অনুবাদের কাজ তিনি কিছু কিছু করিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে তাঁর অনেক কাজ হয়েছে। বিদেশিরাও রবীন্দ্ররচনা অনুবাদে এগিয়ে এসেছেন। তা ছাড়া তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। জীবনানন্দ দাশের সাহিত্য অনুবাদেও অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। আমি যখন বাইরে ছিলাম নজরুলের অনুবাদ খুঁজেছি, কিন্তু তেমন পাইনি। বাংলাদেশের অনেকের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, ইংরেজির অধ্যাপকদেরও নজরুল অনুবাদের বিষয়ে বলেছি। কিন্তু তাঁরা তেমন উৎসাহ দেখাননি। আমি আমার মতো চেষ্টা করছি। কিন্তু আমি মনে করি, নজরুলকে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ হয়নি বললেই চলে। এ জন্য আমাদের পরিকল্পিতভাবে কাজ করা দরকার।
সমকাল: এ সময়েও কাজী নজরুল ইসলাম কতটা প্রাসঙ্গিক?
নাশিদ কামাল: নজরুলের গান ও তাঁর অন্যান্য সাহিত্যকর্ম যে কোনো সময়ের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। আমাদের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে নজরুলের কবিতার আবেদন নিঃশেষ হবে না। নজরুলের গান, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ সবকিছুতেই আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ খুঁজে পাই। ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামকে সফল করার জন্য তিনি সর্বজনীন মানুষ এবং কবি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন- অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,/ কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি-পণ!/ 'হিন্দু না ওরা মুসলিম?' ওই জিজ্ঞাসে কোন্‌ জন?/ কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা'র! তিনি স্বাধীনতার কবি, সাম্যের কবি, মানবতার কবি- সর্বোপরি বিদ্রোহী তাঁর তুলনা শুধু তিনিই। তবে নজরুল সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনার জন্য।
সমকাল: কাজী নজরুল ইসলামের অসাম্প্রদায়িক চেতনা আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
নাশিদ কামাল: নজরুল মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখেছেন। তিনি হিন্দু-মুসলিম তথা ধর্মে ভেদরেখা টানেননি। অসাম্প্রদায়িকতার মূলকথা এটাই। নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা তাঁর দর্শন মানিনি। গত বছরও আমরা দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা প্রত্যক্ষ করেছি। কুমিল্লাসহ দেশের নানা জায়গায় যেসব ঘটনা ঘটেছে আমার মনে হয়েছে, আমার দাদা শিল্পী আব্বাসউদ্দীন যেমন মানুষকে সচেতন করে ১৯৪৬ সালে ট্রাকে করে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গান গেয়ে শহর ঘুরেছেন, এমনি এখনও আমার শহরে গান গাওয়া উচিত। নজরুলের সাম্যবাদী, মানুষ এবং দুর্গম গিরি কান্তার... কবিতায় তিনি অসাম্প্রদায়িকতার জয়গান গেয়েছেন। নজরুল বলেছেন, মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মোসলমান/ মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ। আজকে কেবল এই উপমহাদেশেই নয়, বিশ্বের যেখানেই আমরা বৈষম্য দেখছি, সাদাকালোয় প্রভেদ দেখছি, গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ্ব দেখছি সেখানেই নজরুল প্রাসঙ্গিক। সব সাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্য ও জুলুমের বিরুদ্ধে নজরুল এক প্রেরণার নাম।
সমকাল: নজরুলসংগীত চর্চায় বর্তমান প্রজন্ম কতটা এগিয়ে আসছে?
নাশিদ কামাল: নজরুলসংগীত চর্চায় বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহের কোনো ঘাটতি আমি দেখছি না। আমি তাদের নিয়ে ভীষণ আশাবাদী। এখানেও অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের কথা বলা প্রয়োজন। তিনি সারাদেশে নজরুলসংগীত ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় কাজ করেছেন। আমরা নজরুলশিল্পীরা এমনি এক প্রজেক্টে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে নজরুলসংগীত শিখিয়েছি। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আমরা দেখেছি, কত আগ্রহ নিয়ে সবাই আসছে। গান শিখছে। নজরুলসংগীতশিল্পী পরিষদের সঙ্গেও আমি যুক্ত। সে সূত্রেও নজরুলসংগীত চর্চায় বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে আগ্রহ ও উদ্দীপনা দেখার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, তাদের উঠিয়ে আনা। দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব প্রতিভা ছড়িয়ে আছে, তাদের জাতীয় পর্যায়ে আনার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
সমকাল: পশ্চিমবঙ্গে নজরুলের চর্চা কেমন দেখছেন?
নাশিদ কামাল: ভারতের পশ্চিমবঙ্গ যেহেতু বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা, সেখানেও নজরুল চর্চা হচ্ছে। সেখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকেই নজরুলসংগীত চর্চা করছেন। তবে প্ল্যাটফর্ম কম। মানে আমাদের এখানে যেমন নিয়মিত নজরুলসংগীতের অনুষ্ঠান হয়, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে যেমন নজরুলসংগীত প্রচার হয়, পশ্চিমবঙ্গে তার অভাব রয়েছে।
সমকাল: দেশে একাডেমিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা কেমন দেখছেন?
নাশিদ কামাল: নজরুলের বহুমুখী চর্চা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ ও বিভিন্ন সংগঠনে নজরুল চর্চা হচ্ছে। একাডেমিক ক্ষেত্রে কিছু কাজ হচ্ছে। আমাদের নজরুল ইনস্টিটিউট রয়েছে। ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজ রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও নজরুল চর্চা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে এ চর্চা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। ইউজিসির পক্ষ থেকে যেমন বাংলাদেশ স্টাডিজসহ কয়েকটি কোর্স পড়ানোর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেখানে নজরুল স্টাডিজও বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। শিক্ষার সব স্তরে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। বাংলা ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এবং ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নজরুল যাতে পড়ানো হয়, তা নিশ্চিত করা চাই।
সমকাল: নতুনভাবে কাজী নজরুল ইসলামকে আবিস্কারের সুযোগ কতটা রয়েছে?
নাশিদ কামাল: নজরুলকে নতুনভাবে আবিস্কারের সুযোগ অবশ্যই রয়েছে। এত বছর ধরে আমি নজরুল চর্চা করছি, তারপরও আমার কাছে পুরাতন মনে হয় না। তিনি যে সংগীত রচনা করেছেন; কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখেছেন; তা নিয়ে যত গবেষণা হবে, আমরা নতুন নতুন দিকনির্দেশনা পাব। তাঁর মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য, তা অতুলনীয়।
সমকাল: নজরুল চর্চা আরও বাড়াতে আমাদের করণীয় কী?
নাশিদ কামাল: নজরুল চর্চা যেমন বাড়ানো দরকার, তেমনি নজরুলের দর্শন প্রচার আরও জরুরি। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে নজরুলের নিয়মিত অনুষ্ঠান করা প্রয়োজন। নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। সে জন্য তো বটেই, তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণেও তাঁর চর্চা বাড়ানো দরকার। নতুন প্রজন্মের কাছে নজরুলকে আরও ভালোভাবে উপস্থাপন করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার প্রয়োজন। আগে যেমন গানের অ্যালবাম হতো, এখন সেখানে ইউটিউব বড় মাধ্যম। ইউটিউবে দেখেছি, নজরুলের গানের অনেক দর্শক। আমরা হয়তো ৫০ বছরেও যত মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারি না, ইউটিউব সেখানে অল্প সময়ে পৌঁছাতে পারে। তাই পরিকল্পিতভাবে তথ্যপ্রযুক্তিতে নজরুল চর্চা বাড়ানো প্রয়োজন। আমাদের সময়ে নজরুলসংগীত যাঁরা গাইছেন, অনেকেরই বছর ষাটোর্ধ্ব, তাঁদের পরে এখানে যাতে শূন্যতা তৈরি না হয়, সে জন্য বর্তমান প্রজন্মকে উঠিয়ে আনতে পদক্ষেপ জরুরি।
সমকাল: নজরুল সাহিত্য ও সংগীত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও পরিচিত করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?
নাশিদ কামাল: আন্তর্জাতিকভাবে পৌঁছাতে হলে নজরুল সাহিত্য অনুবাদ নিঃসন্দেহে বড় মাধ্যম। ইংরেজি অনুবাদ করে অ্যামাজনের মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে দিতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে নজরুলের গবেষণা, নজরুল নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা এবং বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে নজরুল চর্চা হয়, সে জন্য তাদের সঙ্গে কাজ করা। সর্বোপরি বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে বাঙালি যদি নজরুলকে ধারণ করেন, এর মাধ্যমেও নজরুলের আন্তর্জাতিকীকরণ হতে পারে।
সমকাল: কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে?
নাশিদ কামাল: নজরুলের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ১৯৭২ সালের ২৪ মে। তাঁকে যখন দেশে আনা হয়, আমিও তখন গাড়িবহরে ছিলাম। আমি তখন হলি ক্রস স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্রী। কবিকে নিয়ে আসতে বাবাসহ গিয়েছিলাম বিমানবন্দরে। সেখান থেকে তাঁদের নিয়ে যাই ধানমন্ডিতে কবি-ভবনে।
সমকাল: আজ কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। এখন তিনি বেঁচে থাকলে তাঁকে কোন গানটি শোনাতেন?
নাশিদ কামাল: 'তুমি কোন পথে এলে হে মায়াবী কবি/ বাজায়ে বাঁশের বাঁশরি/ এল রাজ-সভা ছাড়ি ছুটি গুণীজন/ তোমার সে সুরে পাশরি।'
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
নাশিদ কামাল: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।