Mahfuzur Rahman Manik
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের উভয় সংকট
মার্চ 11, 2022

মূল লেখক : শশী থারুর 
ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক

ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধে ভারতের কৌশলগত দুর্বলতাসহ আরও কিছু বিষয় সামনে এসেছে। বিশ্বে দেশটির অবস্থান, তার আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং দীর্ঘ মেয়াদে সম্পর্কের বিচক্ষণতা নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন উঠছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর প্রতিবাদে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ডাকা জরুরি অধিবেশনে নিন্দা প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল ভারত। প্রাথমিকভাবে ভোটের বিষয়ে ব্যাখ্যায় ভারত রাশিয়ার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি কিংবা এই আক্রমণে অনুতাপ বোধ করেনি। এমনকি ইউক্রেনের দুটি অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের স্বাধীনতায় রাশিয়ার স্বীকৃতির বিষয়েও ভারত কোনো টুঁ শব্দ করেনি।
যদিও আলোচনা ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইউক্রেনের এই সংকটের সমাধান করার আহ্বানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকার ভারতের দীর্ঘদিনের নীতিরই চর্চা করেছেন। এ যুদ্ধে যখন মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, এমনকি ভারতের একজন শিক্ষার্থী রাশিয়ার গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন এবং খারকিভে খাদ্য সংকটের দীর্ঘ সারি দেখা যাচ্ছে, সে সময়ও মোদি সরকারের কোনো ধরনের সমালোচনা, নিন্দা ছাড়া কেবল শান্তির আলোচনা বেহুদা বৈকি।
ভারতের এই সংযমের গূঢ়ার্থ অনুধাবন করা কঠিন নয়। ভারতের অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জামের অর্ধেকই জোগান দেয় রাশিয়া। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক চুক্তি তার চেয়েও বেশি। সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় থেকেই ক্রেমলিনের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক যোগাযোগ সুদৃঢ় হয়ে আছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন কাশ্মীর বিষয়ে জাতিসংঘে ভারতের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। এমনকি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যখন পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল, তখন ভারতের পক্ষে ক্রেমলিনের পক্ষে থাকা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
চীনের সঙ্গে রাশিয়ার দহরম-মহরম ও ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক কিছু সময়ের জন্য ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের উদ্বিগ্ন করছিল। ক্রেমলিনও দৃশ্যত পাকিস্তানকে চীনের 'ক্লায়েন্ট স্টেট' হতে উদ্বুদ্ধ করছে। রাশিয়া যেদিন ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করে, ওই দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ছিলেন মস্কোতে। সেদিন তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিনের সঙ্গে যে বৈঠক করেন, সেটিই প্রমাণ করে এই উপমহাদেশে রাশিয়ার সমীকরণ বদলে গেছে। ভারত সম্ভবত মনে করছে, রাশিয়ার সঙ্গে তারা সম্পর্ক ধরে রাখবে, যাতে হারাতে না হয়।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত পশ্চিমা বিশ্বের দিকেও ঝুঁকছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্পর্কের আমরা তাৎপর্যপূর্ণ সামরিক বন্ধনও দেখছি। বলার অপেক্ষা রাখে না, চীনকে টেক্কা দেওয়ার জন্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন গঠিত জোট 'কোয়াড'-এর সদস্য ভারত। এ জোটের সঙ্গে রয়েছে জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। তবে ভারতের নেতারা অনুধাবন করছেন, রাশিয়ার এই আক্রমণের ফলে কোয়াডে যোগ দেওয়া অর্থহীন এবং এ জোটের অন্য শরিকদের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কও লেজেগোবরে অবস্থা। ফলে ভারত সরকার নিজেকে একটি রশির ওপর ঝুলে থাকা অবস্থায় দেখতে পাচ্ছে; যে কোনো দিকে ঝুঁকে পড়া নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।

ইউক্রেন যুদ্ধ ভারতকে আরেকটি কৌশলগত চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইউক্রেন সংকট এ পর্যায়ে গড়ানোর আগেও মনে হয়েছে, চীন কর্তৃক হুমকির বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক হুমকি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের পরিবর্তে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দৃষ্টি দেয়। তবে এখন অবস্থাদৃষ্ট প্রতীয়মান হয়, রাশিয়ার সঙ্গে বিপরীতমুখী অবস্থানের বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় বিবেচনা করবে। এর ফলে চীনের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতা কমে আসবে। ভারতের উত্তরাংশের প্রতিবেশী চীন। ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ কাশ্মীর অঞ্চলের লাদাখ সীমান্তে চীনের সঙ্গে সংঘাতে অন্তত ২০ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হওয়ার দুই বছরও পূর্ণ হয়নি। গত তিন দশকে ভারত-চীনের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ ভূখণ্ড এবং সীমান্ত সংকট নিয়ে কয়েক দফা আলোচনা হলেও যা হোক, এ সবকিছু এমন সময়ে ঘটছে, যখন আফগানিস্তানের পক্ষ থেকেও রয়েছে সর্বাধিক নিরাপত্তা হুমকি। কারণ, সেখানে ক্ষমতায় এখন তালেবান, যারা দুই দশক আগেও সেখানকার ক্ষমতায় ছিল। এ অঞ্চলে চীন যে সামরিক অবকাঠামো তৈরি করছে, তা তালেবানকে উপকার করছে এবং ইরানের পথ প্রশস্ত করছে। একই সঙ্গে কাশ্মীরে পাকিস্তান সমর্থিত জঙ্গি বৃদ্ধি করছে, যা ভারতকে আত্মরক্ষার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাশিয়া, চীন ও ইরান সম্প্রতি ভারত মহাসাগরে একটি যৌথ সামরিক মহড়ার আয়োজন করে। 'মেরিন সিকিউরিটি বেল্ট' নামে পরিচিত দেশ তিনটির এটি ছিল তৃতীয় মহড়া।
এ অঞ্চলে ভারতের প্রথাগত বন্ধুরাও দেখছে বাতাস কোন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। নেপাল এরই মধ্যে চীনকে তার উত্তর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বিশাল রেললাইন ও হাইওয়ে স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। ভুটান গত বছরের অক্টোবরে একটি সীমান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করে চীনের প্রত্যাশিত ভূমি দিয়ে দিয়েছে। এর ফলে ভারতের সঙ্গে ভবিষ্যতে সংঘাতে চীন বড় সুবিধা পাবে। বলা বাহুল্য, ভারতের অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশী দেশের অধিকাংশই চীনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ'-এর সদস্য। চীনের উদ্যোগে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআইকে এশীয় বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন সুযোগ বলা হলেও বিআরআই দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে নতুন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, ভারতের অবস্থান এ উদ্যোগের বিপরীতে।
এসব দেশে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধি স্বাভাবিকভাবেই ভারতের নিজের অঞ্চলে তার কূটনৈতিক প্রভাব কমিয়ে দিচ্ছে। ভারতের পূর্বে রয়েছে মিয়ানমার। সেখানকার সামরিক জান্তা ইতোমধ্যে চীনের সঙ্গে 'বিশেষ সখ্য' ঘোষণা করেছে। যেখানে তার পূর্ব ক্ষমতাসীনরা ভারতকে চীনের গুরুত্বপূর্ণ পাল্টা শক্তি হিসেবে বিবেচনা করত।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ ভারতকে উভয় সংকটের বিড়ম্বনায় ফেলেছে। নীতিগতভাবে ভারত পশ্চিমা গণতন্ত্রবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়টি পছন্দ করে থাকবে। এর মধ্যে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কথা আসবে। অথচ এর মধ্যে চীনকে নিবৃত্ত করতে রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক ধরে রাখতে চাইছে ভারত। স্বাভাবিকভাবেই ভারত এখন দোটানায় রয়েছে। এ অবস্থায় ভারত পশ্চিমাদের শত্রু হয়ে উঠতে পারে। বলতেই হবে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ভারতের স্বার্থ নানা দিক থেকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। গোষ্ঠী বা জোটনিরপেক্ষতা এমন দেশের সর্বোচ্চ গ্রহণের সুযোগ থাকে, যে দেশটি প্রতিবেশী শত্রু দ্বারা আক্রান্তের আশঙ্কা থাকে। এ অবস্থায় ভারতকে হয় ঐতিহাসিক হবসনের পছন্দ গ্রহণ করতে হবে, না হয় মোদির।
শশী থারুর: ভারতীয় লেখক ও রাজনীতিক; উই ফর নিউজ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।