Mahfuzur Rahman Manik
বরিস জনসনের 'পার্টিগেট' ও ইতিহাসের বিচার
জানুয়ারী 23, 2022

মূল লেখক : সোনিয়া পার্নেল
ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ১২ জানুয়ারি যখন জ্বরভাবাপন্ন সংসদে ব্রিটিশ আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে কথা বলেন, তিনি কিছু সময়ের জন্য এমনভাবে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন, যেন তিনি মুক্তি চান। তাহলে কি তিনি ২০২০ সালে কভিড-১৯-এর সময়ে কঠোর লকডাউনের মধ্যেও ডাউনিং স্ট্রিটে পার্টির জন্য বিরোধী সাংসদদের উচ্চস্বরে উপহাস থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রার্থনা করছিলেন? যদিও তিনি গত কয়েক মাস ধরে বলে আসছিলেন, তিনি কোনো আইন ভাঙেননি। কিংবা তিনি তার দলের ক্রুদ্ধ সদস্যদের রুদ্র মূর্তি থেকে বাঁচতে চেয়েছেন। কিংবা লাখো মানুষের করুণ চাহনি থেকে, যারা বৃহৎ স্বার্থে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে লকডাউন মেনেছিলেন, এমনকি তারা হয়তো মৃত্যুবরণকারী তাদের মা-বাবা কিংবা বন্ধুদেরও বিদায় জানাতে পারেননি।

বরিস জনসনের শো সেদিন বক্স অফিস হতে পারে কিন্তু এটি আর সেই কমেডির মধ্যে নেই, যেটি ব্রিটেনের এক সময়কার জনপ্রিয় অভিনেতার কাছে মানুষ প্রত্যাশা করে। আমি চেয়েছিলাম তার গভীর অনুশোচনা। কিন্তু তিনি ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে পূর্ণমাত্রার একটি রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দেন, যার পুরোটা তারই সৃষ্টি। স্কটিশ কনজারভেটিভ নেতা ডগলাস রস থেকে শুরু করে অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা সবাই বরিস জনসনের বিপক্ষে। এমনকি কনজারভেটিভ সংসদরা ইতোমধ্যে অনাস্থার চিঠি দাখিল করেছেন।

এই তো কয়েক সপ্তাহ আগে বরিস জনসন প্রায় ৮০ আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। এমনকি কথা উঠছিল, এক দশক পর্যন্ত তিনি বুঝি ক্ষমতায় থাকবেন। তিনি ব্রেক্সিট সম্পন্ন করার (যদি ধ্বংসাত্মকভাবে) মাধ্যমে ব্রিটেনের ইতিহাসের গতি পাল্টে দেন, যার মাধ্যমে মনে হচ্ছিল তিনি কেবল তার দলের মধ্যেই নয় বরং গোটা দেশের মধ্যেই অজেয়।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে একটি ব্রিটিশ সংবাদপত্রে তার সাবেক সহকর্মী হিসেবে এবং তার স্বাধীন জীবনীকার হিসেবে আমি তাকে বছরের পর বছর খুব কাছ থেকে দেখেছি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উল্লেখযোগ্য, যা যে কাউকে ডোবাতে পারে। তার ডাউনিং স্ট্রিট ফ্ল্যাট আধুনিকায়নের অর্থায়নে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ব্রেক্সিট প্রচারণায় তার মিথ্যা ভাষণের কারণে এখন ব্রিটিশ অর্থনীতি খারাপ ফল ভোগ করছে। অর্থনীতির সংকটের পাশাপাশি আয়ারল্যান্ডে শান্তি বিনষ্টের পথে। সুতরাং, চার্জশিট অনেক। তারপরও ব্রিটিশ জনগণের ক্ষমা তিনি পেতে পারেন।

কিন্তু 'পার্টিগেট' অভিযোগ মানুষ কীভাবে নেবে। ওই দিন তিন ফটোগ্রাফারকে এড়িয়ে ডাউনিং স্ট্রিট ত্যাগ করেন। হাজারো মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের খেদ ঝেড়েছেন। সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি ভালো করেই এসেছে। ডেইলি মিরর 'ডিসগ্রেইস' বা অপমান লিখে প্রথম পাতাজুড়ে বিষয়টি এনেছে। কনজারভেটিভ-ঘেঁষা টাইমস অব লন্ডন জনমত জরিপ করে বলেছে, এ ঘটনায় ১০ জনের ছয়জন ভোটারই বরিস জনসনের পদত্যাগ চায়। সামনে নিশ্চয়ই আরও কিছু আমরা দেখতে পাব।

এটি কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হৈচৈ ফেলেনি বরং এটি এমন বিষয় যাতে জাতির হৃদয় ভেঙেছে। বরিস জনসন অবশেষে তাকে মানুষের ভাবনায় দেখছেন। এখানে বিচারকরা নিশ্চয়ই তার বিরুদ্ধে, কারণ তিনি আমাদের ত্যাগ ও বেদনাকে তুচ্ছ করেছেন।

২০২০ সালের ১৯ মে, অর্থাৎ ডাউনিং স্ট্রিট গার্ডেনের সেই কুখ্যাত পার্টির আগের দিনটিতে আমি আমার মাকে সমাহিত করেছিলাম। তিনি ছিলেন এমন নারী, যিনি একসময় পেইন্ট করতে পছন্দ করতেন। তিনি সমুদ্রে সাঁতার কাটতেন এবং বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দময় সময় কাটাতেন, তিনি করোনায় মৃত্যুবরণ করেন। ওই বছরের মার্চ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার দেখা করার অনুমতি ছিল না। কারণ তখন লকডাউনে কড়াকড়ি চলছিল এবং সে সময় স্বাস্থ্য খাত ব্যাপক চাপ সামলাচ্ছিল। ওই সময় আমি ই-মেইলে তার মৃত্যুর খবর পাই। অথচ এসব কড়াকড়ি বরিস জনসনই আরোপ করেছিলেন। আমার মায়ের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে মাত্র ১০ জনকে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়। আত্মীয়স্বজন, তার বন্ধুবান্ধব এমনকি আমাদের প্রতিবেশীদেরও ওই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। আমার ক'জনকে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়। কফিন স্পর্শ করা নিষিদ্ধ ছিল বিধায় আমি তার পাশে একটি সাদা ফুল রাখি। আমরা কেউই কফিন স্পর্শ করতে পারিনি।

আমার মা এমন হাজারো মানুষের অন্যতম, যারা একাকী মৃত্যুবরণ করেন। ছেলেমেয়েরাও তাদের মা-বাবাকে বিদায় জানাতে পারেনি। এমনকি যেসব মা সন্তান হারিয়েছিলেন, সেসব মাও তাদের সন্তানকে বিদায় জানাতে পারেননি। ওই সময়ের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল, পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধবদের ছাড়াই এসব শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। লাখো মানুষ জাতির সুরক্ষা বিবেচনা করে এমন নানা আত্মত্যাগের মাধ্যমে এসব কড়াকড়ি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু বরিস জনসন এটা কী করেছেন। তার প্রতি ক্রোধ জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক। এমনকি তার অসম্মানজনক আচরণ তার প্রতি ঘৃণাই উদ্রেক করে।

আমরা এ ঘটনার অভ্যন্তরীণ তদন্তের ফলের জন্য অপেক্ষা করছি। এখনও বরিস জনসনের রাজনৈতিক ইতি আসন্ন নাও হতে পারে। কারণ তার দলের অন্তত ৫৪ সদস্যকে তার বিরুদ্ধে অনাস্থার চিঠি দিতে হবে। সেই সংখ্যা পূরণ হওয়া থেকে আমরা অনেক দূরে রয়েছি। যদিও জাতীয় আলোচনা 'পোস্ট-বরিস' এরা বা বরিস-পরবর্তী শাসনের দিকে গড়াচ্ছে।

বুধবারের দুঃখজনক ঘটনার কথা চিন্তা করে আমি আবারও আমাকে প্রশ্ন করি, বরিস জনসনের দৃষ্টি যেখানে আকাশছোঁয়া, সেখানে এখন তার চিন্তা কী হতে পারে। আমার মনে হয়, তিনি এ সত্যের মুখোমুখি, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ব্যর্থ এবং ইতিহাস তাকে কঠিনভাবেই বিচার করবে।

সোনিয়া পার্নেল : সাংবাদিক ও লেখক; বরিস জনসনের সাবেক সহকর্মী; নিউইয়র্ক টাইমস থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।