মূল: আর রামকুমার
ভারত সরকারের তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সেখানকার কৃষকদের আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক বিজয়। এক বছরেরও অধিক সময় ধরে হাজার হাজার কৃষক দিল্লি অবরোধ করে রাখেন। তাদের অবরোধ স্বদেশি আন্দোলনে পরিণত হয়। দেরি হলেও সরকার গত শুক্রবার একটি বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের মাধ্যমে কৃষকদের আন্দোলনের অবসান হয়েছে। উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের নির্বাচনের আগমুহূর্তে এসে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আন্দোলনকারী কৃষকদের কাছে সরকার নতিস্বীকার করেছে। যদিও আন্দোলকারীদের সন্ত্রাসী কিংবা খালিস্তানি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাদের লংমার্চে টিয়ার শেলের গ্যাস ছোড়া হয়েছে। মারা গেছেন অনেকে। এত নির্দয় আচরণের পরও তারা যেভাবে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন, সে জন্য তাদের স্যালুট জানাই।
বস্তুত ১৯৯১ সালের পরই ডানপন্থি অর্থনীতিবিদরা কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলেন। ষাটের দশকের পর ভারতের কৃষিতে সহায়তার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ছিল। এই সহায়তার আওতায় কৃষিপণ্যের মূল্য, ভর্তুকি, বাজারজাতকরণ, গবেষণা ও সম্প্রসারণের যে কাজ হয়, তার ফলে ভারতে ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে। কৃষির বাজারজাতকরণের ওপর প্রথম আঘাত আসে এগ্রিকালচারাল প্রডিউস মার্কেট কমিটি-এপিএমসির মাধ্যমে। এ আইন রাজ্যগুলোতে পাস হয়। যুক্তি দেওয়া হয়, ভারত যদি তার ফসলে বৈচিত্র্য এনে রপ্তানিমুখী ও উচ্চমূল্যের ফসল পেতে চায়, তবে মান্দির জন্য বেসরকারি বাজার, ভবিষ্যৎ বাজার ও চুক্তিভিত্তিক কৃষি দূরে সরাতে হবে। এপিএমসি আইন কৃষককে বৈষম্যের শিকার করেছে। কারণ, তারা বড় করপোরেট ক্রেতা ও রপ্তানিকারকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে না। তাই এপিএমসি আইন সংস্কার জরুরি। ২০০৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার কৃষির বাজারজাতকরণে একটি মডেল তৈরি করে রাজ্যগুলোতে পাস করার জন্য প্রেরণ করে। এরপর ২০১৭ ও ১৮ সালে আরও দুটি মডেল প্রস্তুত করে। এসব মডেল যেমন রাজ্যগুলো গ্রহণ করেনি, আবার বাতিলও করেনি। কয়েকটি রাজ্য ২০০৩ থেকে ২০ সালের মধ্যে সেখান থেকে কিছু অনুচ্ছেদ গ্রহণ করে সে অনুযায়ী এপিএমসি আইন সংশোধন করে।
ভারত ২০২০ সালে কৃষি আইন করে কৃষি বাজারজাতকরণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। আইনের কিছু ধারার মাধ্যমে বস্তুত কৃষি আইনটি অসাংবিধানিক হিসেবে সামনে আসে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টেও আইনের বিষয়টি ওঠে। যারা কৃষি আইনকে জনসমক্ষেই সমর্থনের কথা বলে, তারা আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলোচনা না করে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। ফলে কৃষকদের সংগঠনগুলো ওই কমিটির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখে এবং তাদের আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। সাংবিধানিক দিক ছাড়াও কৃষি আইনের কিছু অধ্যায় এমনিতেই সমালোচনার মুখোমুখি হয়।
ভারতে 'বিতর্কিত' তিন কৃষি আইন ছিল- ফারমার্স প্রডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) অ্যাক্ট, ২০২০; ফারমার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রটেকশন) এগ্রিমেন্ট অব প্রাইস অ্যাশিওরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস অ্যাক্ট, ২০২০ ও এসেনশিয়াল কমোডিটিজ (সংশোধিত) বা অত্যাবশ্যক পণ্য আইন। সরকারের দাবি, এই কৃষি আইনে বড় ব্যবসায়ীদের মনোপলি বন্ধ হবে। কৃষক যেখানে খুশি শস্য বিক্রি করতে পারবেন। এ আইনে আন্তঃরাজ্য বাণিজ্যের ওপর জোর দেওয়া হয়। পরিবহন খরচ কমানোর প্রস্তাবও করা হয়। সর্বোপরি উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের কৃষি-বাণিজ্য সংস্থা এবং খুচরা পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত করা। কৃষকদের অভিযোগ ছিল, এ আইন বাস্তবায়িত হলে সরকার ধীরে ধীরে নূ্যনতম সহায়তা মূল্যে বাজার থেকে ফসল কেনা বন্ধ করে দেবে। বাজার থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ সরে যাবে। কৃষকদের পুঁজিপতিদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। ব্যবসায়ীরা কৃষকদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে।
এর ফলে কয়েকটি রাজ্য থেকে কৃষকদের আন্দোলন শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে এ আন্দোলন পশ্চিম-উত্তর প্রদেশে বিস্তৃত হয় এবং সেখান থেকে অন্যান্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক মাসের মধ্যে আন্দোলন প্রসার লাভ করে ভারতীয় স্বদেশি আন্দোলনে পরিণত হয়। এর মধ্যে স্থানীয় ভূমির আন্দোলন যোগ হয়ে কৃষি আইন বাতিলের দাবি আরও জোরদার হয়। এমনকি নারীদের একটি বড় অংশও আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। আন্তর্জাতিকভাবেও এটি ব্যাপক সাড়া ফেলে।
কৃষকের আন্দোলন ভারত সরকার প্রথমে আত্মম্ভরিতা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সরকারের শিশুসুলভ আচরণও প্রকাশ পায়। পপ স্টার রিয়ানা কৃষকদের আন্দোলন নিয়ে একটি মন্তব্য টুইট করলে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অযাচিত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। তাদের এ আচরণ আসলে অসহিষ্ণুতারই পরিচায়ক। কৃষি আইনগুলো বাতিল হওয়ার মাধ্যমে কৃষক ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যকার কুৎসিত দ্বন্দ্বের আপাতত অবসান ঘটেছে। এ আন্দোলনের প্রভাব নিশ্চয়ই আরও চলবে। এর বার্তা স্পষ্ট- দৃঢ় আন্দোলন যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে, তা একটি আগ্রাসী সরকারকেও নতজানু করতে পারে।
অধ্যাপক, টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস, মুম্বাই। ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক