লকডাউন যখন ১১ আগস্ট থেকে লকমুক্ত হলো, তখনও গণপরিবহন কিংবা পর্যটনের ওপর কিছু বিধিনিষেধ ছিল। বৃহস্পতিবারের সরকারি ঘোষণায় সেটিও প্রায় মুক্ত করা হলো। ১৯ আগস্ট থেকে পুরোদমে সব খোলা। যানবাহন চলবে শতভাগ যাত্রী নিয়ে। মার্কেট চলছে আগের নিয়মে। ব্যাংকসহ সব প্রতিষ্ঠান চলছে পূর্ণ কার্যদিবস। কিন্তু যেটা খোলা প্রত্যাশিত এবং জরুরি ছিল, সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই খোলা হয়নি। একটানা এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে প্রশাসনের ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত কেবল প্রায় চার কোটি শিক্ষক-শিক্ষার্থীই দিচ্ছেন না; বরং জাতি হিসেবে আমরা সবাই দিচ্ছি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে ১১ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি যদিও বলেছেন, সেপ্টেম্বরেই স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে। তারপরও আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের দোলাচলই দেখি। বলাবাহুল্য, যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আমরা দেখেছিলাম গত বছরের ঠিক এ সময়ে। তখনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সব খোলা হয়েছিল। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোল হয়নি। এভাবে নীতিনির্ধারকদের সঠিক সময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে না পারার কারণে একটানা দেড় বছরের অধিককাল পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে বিশ্বে রেকর্ড গড়ছে বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত ২২ দফায় ছুটি বেড়ে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সব যখন মহাসমারোহে খুলেছে, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে কেন এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব? অবস্থার বিচারে ছুটি আর না বাড়িয়ে সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা জরুরি। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া সম্পন্ন হওয়ার কথা। ফলে আবাসিক হল খুলে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ও খুলে দিতে বাধা থাকবে কেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্কুলের ছুটিও ৩১ আগস্টের পর আর বাড়ানো উচিত হবে না। আমরা জানি, স্কুল খোলার প্রস্তুতি শিক্ষা প্রশাসন ইতোমধ্যেই নিয়ে রেখেছে। কারণ কয়েকবারই খোলার প্রস্তুতি নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং করোনার দোহাই আর না দিয়ে সরকারকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন খুলে দেওয়া উচিত, তার স্বপক্ষে গত মাসে জাতিসংঘের দুটি সংস্থা ইউনিসেফ ও ইউনেস্কো জোরালো যুক্তি প্রদর্শন করেছে। সংস্থা দুটির প্রধান যথার্থই বলেছেন, 'একটি প্রজন্মকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে নিরাপদে স্কুল খুলে দেওয়ার বিষয়টিকে আপনারা অগ্রাধিকার দিন।' তারা প্রমাণ পেয়েছেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো সংক্রমণ ছড়াতে মুখ্য ভূমিকা রাখছে না। তারপরও কেন আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার তারিখ এখনও ঘোষণা করছি না?
ইউনিসেফ-ইউনেস্কো বলেছে, স্কুলে যেতে না পারায় শিশু-কিশোরদের যে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তা হয়তো কখনোই পুষিয়ে দেওয়া যাবে না। আমরা জানি, ইতোমধ্যেই আমাদের উল্লেখযোগ্য শিশু পড়াশোনা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। অনেক শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে মানসিকভাবে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। তার চেয়ে বড় যে সংকট দেখা যাচ্ছে, তা হলো- অনেক শিক্ষার্থীই মোবাইল ফোন, ল্যাপটপসহ ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে আসক্ত হয়ে পড়েছে। অনেকেরই ইন্টারনেটভিত্তিক গেম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেশা সত্যিই উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছেছে। আমরা দেখেছি, দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নিয়ে অনেকে পড়াশোনা করছে। কিন্তু অধিকাংশই যে এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত, সে কারণে একধরনের বৈষম্য তৈরি হয়েছে।
এ কারণেই ক্লাসে উপস্থিত হয়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্কুলগুলো খুলে দেওয়ার জন্য 'আর অপেক্ষা করা যায় না' বলে মনে করছেন ইউনিসেফ ও ইউনেস্কোর কর্তাব্যক্তিরা। প্রতিষ্ঠান দুটি বলেছে, 'স্কুল বন্ধ রেখে এখন কী লাভ হচ্ছে', এর মাধ্যমে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎকে কার্যত 'জিম্মি' করে ফেলছি। আরও বলেছে, হোটেল-রেস্তোরাঁ যদি আমরা খুলে দিতে পারি, তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন নয়? বলাবাহুল্য, প্রতিষ্ঠান দুটি সম্বোধন গোটা বিশ্বের জন্য হলেও মনে হয় যেন তারা কেবল বাংলাদেশকেই বলছে। তাদের প্রতিটি শব্দচয়ন সত্যিই আমাদের সঙ্গে মিলে যায়।
বিস্ময়েরই বিষয়, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা এভাবে একটানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছেন কোন যুক্তিতে! করোনা যেখানে বৈশ্বিক দুর্যোগ, তারা কি অন্যান্য দেশের দিকে তাকানোর সময় পাননি? ব্যক্তিগতভাবেও অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার অনুরোধ জানিয়ে আসছেন। খোলার ক্ষেত্রে করণীয় কী হবে তার বিস্তারিত অন্য দেশের উদাহরণ দিয়ে প্রস্তুতির কথা সমকালেই গত বছরের জুলাইয়ে লিখেছিলাম- খোলার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কতটা প্রস্তুত? দুঃখজনক হলেও সত্য, করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় বিশ্ব থেকে আমরা শিক্ষা নিইনি। যার প্রমাণ ইউনিসেফের প্রতিবেদন। ১৪৭টি দেশের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে সংস্থাটি বলেছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের মতো এত দীর্ঘ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে বিশ্বের মাত্র ১৩টি দেশ। আরও দুর্ভাগ্য, এই দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ বাংলাদেশ। বলাবাহুল্য, ইউনিসেফের ওই প্রতিবেদন প্রকাশ হয় এ বছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহে। তারপরও প্রায় ছয় মাস চলে যাচ্ছে। এ হিসাবে দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন কত হবে, আমরা জানি না। অথচ গত বছরের শেষ দিকে করোনা সংক্রমণের যে হার ছিল, তাতে চাইলেও প্রশাসন সেপ্টেম্বর থেকে অন্তত পাঁচ মাসের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে পারত। তখন 'নিউ নরমাল' বা নতুন স্বাভাবিকের কথা বলে সবই খুলছিল। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার মতো জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে পাবলিক পরীক্ষাগুলো নেওয়া যেত। বার্ষিকসহ দুটি অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা নেওয়া যেত। অটোপাসের ভ্রান্তি থেকে শিক্ষার্থীরা রেহাই পেত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও সেশনজটে পড়তে হতো না।
এখনও একেবারে সব শেষ হয়ে যায়নি। তাই এখনই ঘোষণা দিয়ে ১ সেপ্টেম্বর থেকে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে অন্তত এ বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তার সমাধান হবে। এখনই সিদ্ধান্ত নিলে শিক্ষার্থীরা অন্তত বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে পরবর্তী ক্লাসে উঠতে পারবে। তাতে অন্তত দুটি শিক্ষাবর্ষের বিশাল গ্যাপে পড়তে হবে না, কিংবা অটোপাসের কবল থেকেও তারা মুক্তি পাবে।
শিক্ষা প্রশাসনসহ দেশের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আর কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টি টিকার শর্তে আবদ্ধ করে আর অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলা নয়। টিকা কার্যক্রম যখন চলবে, তখন যেভাবে অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমও চলছে, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও চলতে পারে। ধীরে ধীরে যেহেতু সংক্রমণ কমে আসছে এবং বিশেষ করে ইউনিসেফ ও ইউনেস্কো যখন বিশ্বের অভিজ্ঞতায় দেখছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে করোনা তেমন ছড়াচ্ছে না, তবে কেন আমরা দেরি করব? তাছাড়া স্বাস্থ্যবিধি ও প্রয়োজনীয় সচেতনতা শিক্ষার্থীরা নিশ্চয়ই সোৎসাহে মানবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। তাই আমরা চাই, এখনই ঘোষণা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিন এবং এ ক্ষেত্রে দুই সপ্তাহে অসম্পন্ন কাজ সম্পন্ন করুন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে আর কোনো বাহানা আমরা শুনতে চাই না।