কর্মজীবী নারীর গর্ভধারণকাল নিয়ে চাকরির জটিলতার চিত্র বিশ্বব্যাপী প্রায় অভিন্ন। এমনকি বিশ্বের ৩৮টি দেশে গর্ভবতী নারীর চাকরি হারানোর ঝুঁকি রয়েছে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে। ১৩ মে বিশ্বব্যাংকের ব্লগে প্রকাশিত 'ইন থার্টি এইট কান্ট্রিস উইম্যান ক্যান স্টিল বি ফায়ারড ফর বিয়িং প্রেগন্যান্ট' শীর্ষক প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছে ইতালির ভলিবল খেলোয়াড় লারা লাগলির চাকরিচ্যুতির ঘটনা দিয়ে। লারার ঘটনা ইতালির আদালত থেকে সিনেট পর্যন্ত গড়ায়। বিশ্বব্যাংকের মতে, কর্মজীবী গর্ভবতী নারীর এমন সংকট চীন, গ্রিস, যুক্তরাজ্য এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও রয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ তথা সিডো সনদ অনুযায়ী নারীর গর্ভধারণ কিংবা সন্তান জন্মদানের কারণে চাকরিচ্যুতিকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নারী কর্মক্ষেত্রে কোনো ধরনের বৈষম্যের স্বীকার হলে কিংবা অবৈধভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত হলে অধিকাংশ দেশেই আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক বলছে, বিশ্বের অন্তত ২০ শতাংশ অর্থনীতিতে গর্ভধারণের কারণে নারী চাকরিচ্যুত হলেও তার আইনের আশ্রয় নেওয়ার কোনো অধিকারই নেই। যেখানে নারীর আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে, সেখানেই কর্মজীবী গর্ভবতী নারী হেনস্তার শিকার হন আর যেখানে সেই অধিকারই নেই, সেখানকার অবস্থা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
নারীর গর্ভধারণের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক অনেক বিষয় জড়িত, যেগুলোর প্রভাব রয়েছে কর্মক্ষেত্রেও। গর্ভকালে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম, বিশেষ যত্ন, খাদ্য ও পুষ্টি পাওয়া এবং তার চেয়েও বড় বিষয় মানসিক সমর্থন। কর্মক্ষেত্রে চাকরিচ্যুতিসহ গর্ভধারণের কারণে অন্য ধরনের বৈষম্যও দেখা যায়। যেমন ধরা যাক, গর্ভবতী কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদোন্নতি আটকে দেওয়া, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কাজের অ্যাসাইনমেন্ট না দেওয়া, মাঝে চিকিৎসককে দেখানোর জন্য ছুটি না দেওয়া। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে সহযোগিতা ও সহমর্মিতামূলক আচরণ না করে বিপরীতমুখী ব্যবহারে গর্ভবতী নারী ভেঙে পড়তে পারেন। তাতে ওই নারীই নন বরং ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে গর্ভের সন্তানও।
বিশ্বব্যাপী কর্মজীবী নারীর সংকটের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত। বিশ্বব্যাংক বলছে, চলমান করোনা-দুর্যোগ এ সংকট আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষ করে এ সময়ে অধিক পরিমাণে ছাঁটাই, স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষার অনিশ্চয়তা গর্ভবতী নারীকে আরও নাজুক করে তুলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভবতী নারীর চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটে গর্ভধারণের প্রথম দিকে। এমনকি মাতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়ার আগেই। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো দেশে গর্ভবতী কর্মজীবী নারী বেশি বৈষম্যের শিকার হন। কেবল আইন দিয়েই নারীর এ সংকট কাটানো সম্ভব নয়; বরং কর্মক্ষেত্রে একটি ন্যায্য ও সুন্দর পরিবেশ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে। এ জন্য জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
করোনা-দুর্যোগের এ সময়ে সার্বিকভাবে নারীর চ্যালেঞ্জ বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, মহামারির কারণে নারীর ওপর সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্বের অনেক দেশেই লিঙ্গবৈষম্য বেড়েছে। দেশে দেশে নারীর প্রতি বৈষম্যপূর্ণ আইন হ্রাস পেলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সুযোগ কমে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী উচ্চ আয়ের দেশ তথা ওইসিডির সদস্যভুক্ত দেশ এবং ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় সার্বিকভাবে নারী এবং বিশেষভাবে কর্মজীবী গর্ভবতী নারী সবচেয়ে বেশি অধিকার ভোগ করেন। এখানে গর্ভধারণের কারণে নারীর প্রতি বৈষম্য কিংবা চাকরিচ্যুতির ঘটনা কম। এদিক থেকে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চল এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে আছে আফ্রিকা। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থ্থানও পেছনের দিকে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থাও তথৈবচ। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সরকারিভাবে যে কোনো কর্মজীবী নারী ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পান। কিন্তু সব বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে সব কর্মজীবী নারী এ সুবিধা পাচ্ছেন না। সন্তান-সম্ভবা অবস্থায় একজন শ্রমিকের নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা তারা পান না। গর্ভবতী শ্রমিক পুরো সময় কাজ করতে পারবে না- এই আশঙ্কায় অনেক সময় তাদের চাকরিচ্যুত করার ঘটনাও ঘটে কারখানাগুলোতে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের একটি জুতা তৈরির কারখানার এক কর্মী ছুটি না পেয়ে টয়লেটের ভেতর সন্তান প্রসব করার ঘটনা ঘটে। পরে সেটি দেশের হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়।
নিরাপদে মা হওয়ার অধিকার প্রতিটি নারীরই রয়েছে। তা ছাড়া নারীর সন্তান হওয়ার বিষয়টি তার একার কিংবা কেবল তার পরিবারেরই বিষয় নয়; এর সঙ্গে দেশ, সমাজ ও উন্নত জাতি গঠনের বিষয়টিও জড়িত। প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতকরণ, মাতৃমৃত্যু রোধ করতে তাই কর্মক্ষেত্রের ভূমিকা অনন্য। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসার বিকল্প নেই। বিশ্বব্যাপী সর্বত্র যেখানে নারীর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ বেড়েছে, সেখানে কর্মজীবী গর্ভবতী নারীর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিই কাম্য। তার বিপরীতে যদি চাকরিচ্যুতির মতো ঘটনা ঘটে, তার চেয়ে বেদনাদায়ক আর কী হতে পারে!