Mahfuzur Rahman Manik
সাইকেলের 'স্বর্ণযুগে' আমাদের দুর্দশা
সেপ্টেম্বর 28, 2020
আলাদা লেন না থাকায় ঢাকায় সাইকেল চালানো যেমনি কঠিন, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণও

করোনাদুর্যোগের সুযোগ হিসেবে সাইকেলের আলোচনা স্পষ্ট। সংবাদমাধ্যমে ইতোমধ্যে আশাজাগানিয়া কিছু খবর আমরা দেখেছি। সমকালের খবর- ভরসা দিচ্ছে দুই চাকার যান। প্রথম আলো বলছে- করোনায় ঘুরছে বাইসাইকেলের চাকা। করোনা থেকে বাঁচতে গণপরিবহনের বদলে অনেকেই সাইকেলে ঝুঁকছেন; এ সময়ে সাইকেলের বিক্রি বেড়েছে; ব্যবসায়ী ও সাইকেল উৎপাদনকারীদের বক্তব্য, কেবল দেশেই সাইকেলের চাহিদা বাড়েনি, বিদেশেও সাইকেল রপ্তানির আদেশ বাড়ছে। এটি সাইকেলের জন্য নিঃসন্দেহে সুখবর। কিন্তু সাইকেলের সুযোগ বাড়লেও ব্যবহার কতটা বাড়বে সে শঙ্কা রয়ে গেছে নানা কারণেই। বিশেষ করে রাজধানীসহ বড় বড় শহরে চাইলেই দুই চাকার এ বাহনটি স্বাচ্ছন্দ্যে চালানো সম্ভব নয়। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকের পক্ষেই সাইকেল চালানো সম্ভব হয় না। নিয়মিত সাইকেল আরোহী হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা বলছে, আলাদা লেন না থাকায় শহরে সাইকেল চালানো যেমনি কঠিন, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণও বটে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশে লকডাউন-পরবর্তী সময়ে সাইকেলকে অগ্রাধিকারে রেখে যেভাবে করোনা ও পরিবহন- দুই সংকট মোকাবিলায় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে আমাদের দেশে তা দেখা যায়নি বললেই চলে। অন্তত প্রতিবেশী কলকাতার উদাহরণও প্রাসঙ্গিক হতে পারে। সেখানে কিছু সড়কে নিরাপত্তার কারণে সাইকেল চালানো বন্ধ ছিল। জুন মাসে কলকাতার সড়কে সাইকেল চালানোর অনুমতি দেয় পুলিশ। বাসের ঠাসাঠাসি ভিড়ে করোনা সংক্রমণের শঙ্কা থেকেই শহরের রাস্তায় সাইকেলে ছাড় দেওয়া হয় কলকাতায়। সেখানে সাইকেল বিক্রি দুই-তিন গুণ বেড়ে গেছে। এমনকি সম্প্রতি সরকারি উদ্যেগে স্বল্প খরচে নিউ টাউন কলকাতা উন্নয়ন পর্ষদ (এনকেডিএ) মানুষের জন্য সাইকেল শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে কলকাতায় সাইকেল লেন তৈরির লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে কলকাতা পৌরসভা, কলকাতা পুলিশ ও পরিবহন দপ্তর।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লকডাউনে যখন দোকানপাট বন্ধ ছিল, তখনও সাইকেলের দোকান ছিল খোলা। করোনাভাইরাস পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে না বলে দীর্ঘমেয়াদে চালানোর জন্য সাইকেল কিনছে সেখানকার মানুষ। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ায় সাইক্লিং একটি জনপ্রিয় খেলা। কিন্তু করোনা মহামারিতে দেশটি নাগরিকদের সাইকেল চালাতে উৎসাহিত করছে। যুক্তরাজ্যের অবস্থাও তথৈবচ। বিবিসি বলছে, সেখানে সাইকেল বিক্রি বেড়েছে দুইশ' ভাগ। করোনার সময়ে অন্যান্য দেশও নাগরিকদের সাইকেল চালাতে উৎসাহ দিচ্ছে। যেসব শহরে সাইকেলের লেন কম সেখানে সাইকেল চালানোর সুযোগ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। জার্মানি, ফ্রান্সের প্যারিস, ইতালির মিলান এ জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। স্কটল্যান্ড পথচারী চলাচল ও সাইকেলের পথ প্রশস্ত করতে বাজেট করেছে। সাইকেলের জন্য বিশেষ উদ্যোগ দেখে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের অনলাইন প্রতিবেদনে প্রশ্ন এসেছে- অতিমারির এ সময় কি সাইকেলের স্বর্ণযুগ?

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সাইকেলের এ 'স্বর্ণযুগে' আমরা নির্বিকার। করোনার এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে চাইলেই গোটা রাজধানীর পরিবহন কাঠামো পরিবর্তন করা যেত। আমাদের প্রাইভেট কার আর গাড়িনির্ভর শহরে যানজট, শব্দ ও বায়ুদূষণ এবং সময় অপচয়ের অন্তহীন সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব হবে? ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্বের সবচেয়ে সাইকেলবান্ধব শহর হিসেবে পরিচিত, যেখানে সড়কে গাড়ির চেয়ে সাইকেলই বেশি চলে। অথচ আমাদের সাইকেলের পথই নেই। আমাদের রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে উড়াল সেতু হয়েছে, মেট্রোরেল হচ্ছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে কিন্তু সাইকেল নিয়ে কোনো পরিকল্পনা দৃশ্যমান নয়। ঢাকায় কেবল আগারগাঁওয়ে ৯ কিলোমিটারের একটি সাইকেল লেন হয়েছে। তবে সেনানিবাসের ভেতরে সাইকেলের লেন বা আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে।

আমাদের বাস্তবতা হয়তো উন্নত বিশ্বের সঙ্গে মিলবে না। একদিকে যেমন এখানে সড়ক কম, দিন দিন আরও সংকুচিত হচ্ছে সড়কের পরিসর। অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি, বিশেষ করে প্রাইভেট কার। ফলে সড়কের সমস্যার সমাধান হয় না। এই বাস্তবতায় উড়াল সেতু কিংবা মেট্রোরেলেরও হয়তো বিকল্প নেই। কিন্তু এ পরিস্থিতি সৃষ্টির আগেই সাইকেলের বিষয়টি ভাবা প্রয়োজন ছিল। এমনকি এ ভাবনা যদি পরিকল্পনাবিদ ও দায়িত্বশীলদের থাকত তারপরও তারা চেষ্টা করতেন। করোনা লকডাউনে একটা সুযোগ ছিল বটে। যে সময় সড়ক যানবাহনমুক্ত ছিল। লকডাউন শিথিল করার আগে আগেও কলকাতা কিংবা ইউরোপ-আমেরিকার মতো সাইকেলের বিষয়টি গুরুত্ব দিলে সরকার সম্ভাব্য সড়কগুলোতে লেন না হোক, অন্তত দাগ দিয়ে চিহ্নিত করে আলাদা চলাচলের ব্যবস্থা করতে পারত। পরবর্তীকালে সাইকেলের বিষয়টি মাথায় রেখে অন্যান্য পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করা যেত।

শহর সুরক্ষার জন্যই সাইকেলের প্রসার জরুরি। পরিবেশবান্ধব সাইকেল শহরের পরিবেশের মান উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে সক্ষম। গাড়ির কালো ধোঁয়া আর ভেঁপুর শব্দে যেখানে জনজীবন অতিষ্ঠ; মোটরচালিত যান যেখানে শহরদূষণে ভূমিকা রাখছে; যেখানে অতিরিক্ত গাড়ি শহরের জনজীবনে স্থবিরতা নিয়ে আসছে; সেখানেই জরুরি সাইকেল। বলা বাহুল্য, সাইকেল ব্যক্তির স্বাস্থ্য ঠিক রাখে। প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে যিনি কর্মক্ষেত্রে আসা-যাওয়া করেন তার ব্যায়ামের জন্য অতিরিক্ত সময় অপচয়ের দরকার নেই। করোনার এ সময়ে গণপরিবহনে সংক্রমণের ঝুঁকি যেখানে, সেখানে সাইকেল আপনাকে নিরাপদ রাখতে সহায়তা করবে।

সাইকেলবান্ধব শহর কোপেনহেগেন

আমাদের সাইকেল চালানোর জন্য সড়কে একদিকে আলাদা ব্যবস্থা নেই, অন্যদিকে সামাজিক বাস্তবতায়ও সাইকেল অনেকে 'ভালো চোখে' দেখেন না। কিন্তু সাইকেল কতটা মর্যাদার বাহন সেটা উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অফিসের বড় কর্তা, এমনকি বড় নেতারাও সাইকেল ব্যবহার করেন। ঢাকা শহরের বাস্তবতায় যারা সাইকেল ব্যবহার করেন তাদের উৎসাহিত করা দরকার। রাজধানীর ভয়ানক যানজট, বেপরোয়া গাড়িচালক, মোটরসাইকেলের আধিক্য এবং অসচেতন পথচারীর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করেও যারা ব্যস্ত সড়কে বাইসাইকেল চালানোর মতো কষ্টসাধ্য কাজ করেন তারা পুরস্কারের যোগ্য বটে। এই বাস্তবতায়ও তাদেরই একজন হিসেবে আমার মনে হয় সাইকেল চালানোর মধ্যে প্রশান্তি আছে; এটি আপনার সময় বাঁচাবে; ঠেলাঠেলি করে আপনাকে বাসে উঠতে হবে না; ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসের জন্য অপেক্ষা কিংবা যানজটে বাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে হবে না; আর্থিক সাশ্রয় আর শারীরিক উপকারিতার কথা নাইবা বললাম।

তেল আর মবিল পুড়িয়ে আমরা যেভাবে প্রতিনিয়ত পরিবেশ ধ্বংসে নিজেদের নিয়োজিত করছি, তা থেকে বের হতে সাইকেলই হতে পারে সর্বোত্তম বাহন। সাইকেলকে উৎসাহিত করতে সরকারি পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে। এরই অংশ হিসেবে সম্ভাব্য সড়কে আলাদা সাইকেল লেন তৈরি, সাইকেল চালানোর প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ এবং নিরাপদে সাইকেল রাখার ব্যবস্থা করা চাই। রাজধানীতে নিয়মিত সাইকেল চালায় অথচ চুরির অভিজ্ঞতা হয়নি এমন কাউকে বোধ হয় পাওয়া যাবে না। সাইকেল চালানো ও রাখা উভয় ক্ষেত্রে নিরাপত্তা দেওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকার উন্নত বিশ্ব থেকে ধারণা নিতে পারে। শহর ও ব্যক্তি উভয়ের স্বার্থেই আজ সাইকেল জরুরি হয়ে পড়েছে।

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।