Mahfuzur Rahman Manik
বিসিএসের চেয়ে জীবন অনেক বড়-ড. মোহাম্মদ সাদিক
সেপ্টেম্বর 30, 2020

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক সিভিল সার্ভিসে বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। তিনি শিক্ষা সচিব ও বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব ছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ড. সাদিক বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য 'সিলেটি নাগরী লিপির' ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার জন্ম ১৯৫৫ সালে সুনামগঞ্জে। লেখালেখিতে সক্রিয় ড. মোহাম্মদ সাদিক ২০১৭ সালে কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন

সমকাল: আপনি পিএসসির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান। প্রতিষ্ঠানটির প্রতি আগের তুলনায় যে জনআস্থা ও বিশ্বাস আমরা দেখছি তার কারণ কী বলে আপনি  মনে করেন?

ড. মোহাম্মদ সাদিক: আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। আস্থা ও বিশ্বাসের বিষয়টি যারা বাইরে আছেন আপনারা দেখবেন। পিএসসি পরীক্ষা ও ফল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থী সুপারিশের কাজ করে। কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য আমাদের বিজ্ঞ সদস্যবৃন্দ, পিএসসির সচিব ও সংশ্নিষ্ট সবাই মিলে আমরা একটি টিম হিসেবে কাজ করেছি। এখানে প্রশ্নকারী, মডারেটর, পরীক্ষক, নিরীক্ষক, পরিদর্শক এবং ভাইভা বোর্ডে যারা থাকেন, সবাই মিলেই কাজটি সম্পন্ন হয়।

সমকাল: আপনি স্বচ্ছতার সঙ্গে বিসিএসসহ সরকারি চাকরির পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল বিন্যাসের কথা বলছেন। এ ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো কী?

মোহাম্মদ সাদিক: চ্যালেঞ্জ বহুবিধ। তবে সতর্ক থাকলে তা সহজেই সম্পাদন করা সম্ভব হয়। দেখুন পরীক্ষা গ্রহণের জন্য এর আগে যাদের কথা বললাম তারাই কেবল কাজ করেন না বরং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, সকল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ আরও অনেকেই কাজ করে। এমনকি কোথাও প্রশ্ন ফাঁসের গুজব উঠল কিনা ইত্যাদি দেখতে সরকারের গোয়েন্দারাও কাজ করেন। আমরা বৃহত্তর স্বার্থেই তাদের সবাইকে পরীক্ষা প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করেছি। যেটা আগে ছিল না। আবার তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে প্রযুক্তি ব্যবহার করেও যাতে কেউ অনিয়ম করতে না পারে, সেদিকেও আমাদের দৃষ্টি রাখতে হয়।

সমকাল: পিএসসির মতো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে কোনো চাপ অনুভব করতেন?

মোহাম্মদ সাদিক: সরকার যেহেতু পিএসসিকে সুপারিশের বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে, তাই কাজের ক্ষেত্রে আমি কোনো চাপ অনুভব করিনি। আমার সহকর্মীরা সবাই আমাকে সহযোগিতা করেছেন। সবার সহযোগিতার কারণে সুন্দরভাবে কাজ করতে পেরেছি। তবে হ্যাঁ, হাসতে হাসতে আমি যে কথাটা বলি- পরীক্ষার আগের রাতে সবাই ঘুমাতে পারলেও দায়িত্বের কারণে আমি ঘুমাতে পারি না। বর্তমানে যেভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাই সক্রিয়, তাই একটি গুজবই অনেক ক্ষতি করতে পারে। একটি উদাহরণ দিই- একটি পরীক্ষার আগের রাত ১১টায় গোয়েন্দা সংস্থার এক সদস্য আমাকে জানালেন, ফেসবুকে একজন বলছে, তার কাছে প্রশ্ন আছে। আমি তখনও অফিসে। আমি বললাম, এমন তো হওয়ার কথা না। আমরা পরীক্ষার জন্য কয়েক সেট প্রশ্ন তৈরি করি। কোনটা চূড়ান্ত হবে সেটি পরীক্ষার আগে ঠিক করি। গোয়েন্দা সংস্থাকে বললাম, তাকে ধরেন। পরে দেখা গেল সে পূর্ববর্তী পরীক্ষার প্রশ্নের টপশিট দেখে একটা গুজব রটাচ্ছে। তাকে তাৎক্ষণিকভাবে ধরে ফেলায় গুজবটি ডালপালা মেলতে পারেনি।

সমকাল:
পরীক্ষা ও ফলে স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে বাড়তি কী নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন?

মোহাম্মদ সাদিক
: পিএসসির নিজস্ব প্রেস নেই। তার পরও ছোট ছোট পরীক্ষার প্রশ্নগুলো আমাদের ভালো মানের যে কম্পিউটার আছে, সেগুলো থেকে প্রিন্ট দিয়ে প্রস্তুত করি। পিএসসিতেই একটি প্রশ্ন মুদ্রণকক্ষ তৈরি করেছি। যেটা আগে ছিল না। সেক্ষেত্রেও যারা প্রশ্ন মুদ্রণের কাজ করেন, তারা পরীক্ষার আগে পর্যন্ত ওই রুম থেকে বের হতে পারেন না। বাইরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের পথও বন্ধ থাকে। বড় পরীক্ষার ক্ষেত্রে আমরা একই প্রেস থেকে প্রশ্ন ছাপি না। নিরাপত্তার স্বার্থে একাধিক প্রেস থেকে ছাপার কাজ করা হয়। পরীক্ষার ফল তৈরির ক্ষেত্রে উত্তরপত্রে এখন আর নাম কিংবা রেজিস্ট্রেশন নাম্বার থাকে না। এখন থাকে কোড। পরীক্ষক কোড দেখে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেন। এটি কার উত্তরপত্র তা চিহ্নিত করার সুযোগ নেই।

সমকাল:
আমরা দেখছি প্রতিটি বিসিএসে আগের তুলনায় প্রার্থী বাড়ছে...

মোহাম্মদ সাদিক: সর্বশেষ ৪১তম বিসিএসে সাড়ে চার লাখেরও বেশি আবেদন করেন। ৪০তম বিসিএসেও চার লাখ ছাড়িয়ে যায়। নানা কারণে প্রার্থী সংখ্যা বাড়ছে। প্রথমেই আপনি যেটা বললেন- আস্থা ও বিশ্বাস। তরুণদের মনে এ আস্থা জন্মেছে যে, পিএসসির পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভালো করলে সরকারি চাকরি নিশ্চিত। তা ছাড়া এখন যারা বিসিএস পরীক্ষা দেন, তারা যদি পরীক্ষায় পাস করেন, ক্যাডার সার্ভিসে না হলেও নন-ক্যাডার পেতে পারেন। সরকার ২০১০ সালে একটি বিজ্ঞপ্তিতে এ সুযোগ করে দিয়েছে। সরকারি চাকরিতে এখন সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে। তা ছাড়া এখন প্রতি বছর অধিক পরিমাণে উচ্চশিক্ষা শেষে শিক্ষার্থী চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। বিসিএস তাদের অধিকাংশেরই স্বপ্নের চাকরি।

সমকাল:
সরকারি চাকরিতে নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ পুরোনো। নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত করতে আপনি কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন।

মোহাম্মদ সাদিক
: বিসিএসে দীর্ঘসূত্রতার বাস্তব কিছু কারণ রয়েছে। আগে একটি পরীক্ষা শেষ হলে পরের পরীক্ষার বিজ্ঞাপন প্রকাশ হতো। এখন আমরা প্রতি বছরই বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করছি। ফলে একই সঙ্গে আমাদের কয়েকটি বিসিএসের কাজ করতে হয়। আবার দেখা যায় একজন প্রার্থী একাধিক বিসিএস দিচ্ছেন। যেমন ধরুন একটি বিসিএসের প্রিলিমিনারি যিনি দিচ্ছেন, তার হয়তো আরেকটির রিটেন হয়ে গেছে, আবার অন্য বিসিএসের ভাইভা শেষে ফলের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমরা চাপ নিয়েও একসঙ্গে একাধিক পরীক্ষার কাজ চালিয়ে নিই। আবার বাইরে থেকে অনেকে হয়তো মনে করেন, পিএসসি মানে কেবল বিসিএস পরীক্ষা। অথচ বিসিএস ছাড়াও আমাদের অসংখ্য নন-ক্যাডার পরীক্ষা পরিচালনা করতে হয়। ২০১৯ সাল আমরা শতাধিক নন ক্যাডার পরীক্ষা পরিচালনা করেছি।

সমকাল:
বিসিএসে দীর্ঘসূত্রতা...

মোহাম্মদ সাদিক
: বিসিএসে দীর্ঘসূত্রতার কারণ হলো, একদিকে ক্যাডার অনেক। ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে আবার কিছু আছে সাধারণ বা জেনারেল যেমন- পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, ডাক ইত্যাদি। আবার কিছু টেকনিক্যাল যেমন স্বাস্থ্য, ইঞ্জিনিয়ারিং, শিক্ষা। শুধু শিক্ষা ক্যাডারেই ৮০ থেকে ৯০ ধরনের পদ রয়েছে। কেউ আবার জেনারেল, প্রফেশনাল উভয়টিতেই পরীক্ষা দেন। ধরুন প্রিলিমিনারিতে চার লাখ পরীক্ষা দিলেন। এর মধ্যে ১৬ হাজার টিকলেও তাদের লিখিত পরীক্ষা। প্রফেশনালদের জন্য বিষয় অনুযায়ী আলাদা পরীক্ষা নিতেও সময় ব্যয়। সবচেয়ে বেশি সময় লাগে ভাইভায়। লিখিত থেকে যদি আট হাজার প্রার্থী টেকেন, তাদের ভাইভা নিতে সময় লাগে। ভাইভা আমি মনে করি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তিনজন বিশেষজ্ঞ মিলে ভাইভা নিয়ে থাকেন। তারা প্রার্থীর সার্বিক বিষয় বিচার করেন। প্রার্থী সরকারি চাকরির জন্য কতটা যোগ্য, তা ভাইভার মাধ্যমে যাচাই হয়।

সমকাল:
দীর্ঘসূত্রতা নিরসনে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়?

মোহাম্মদ সাদিক: সময় বাঁচানোর জন্য একটি কেন্দ্রীয় প্রশ্ন ব্যাংক করা যেতে পারে। সেটিও এমন ডাটাবেস আকারে রাখা যাতে প্রযুক্তি ব্যবহার করে কমান্ড দিলেই একটি প্রশ্ন বেরিয়ে আসে। স্বয়ংক্রিয় প্রশ্ন। এছাড়াও সকল বিভাগীয় শহরে পিএসসির নিজস্ব বড় মাল্টিপারপাস হল করা যেতে পারে। সেখানে অন্য পরীক্ষা নেওয়া কিংবা অন্য কাজও হতে পারে। জেনারেল ও টেকনিক্যাল বিষয়গুলো আলাদা পরীক্ষা হতে পারে। টেকনিক্যালে বিষয়ভিত্তিক কম নাম্বারে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে।

সমকাল:
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির আন্দোলন হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন।

মোহাম্মদ সাদিক: সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স নির্ধারণ করার দায়িত্ব সরকারের। সরকার চাইলে বাড়াতে পারে। তবে আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, স্নাতক পাস করার পর একজন শিক্ষার্থী অন্তত ৩-৪টি বিসিএসে অংশগ্রহণ করতে পারেন। আমার মনে হয় না এর চেয়ে বেশি দরকার। এমনকি আমাদের পর্যালোচনায় এসেছে ২৪ থেকে ২৬ বছর বয়সীরাই বিসিএসে সবচেয়ে ভালো করেন। যারা একেবারে ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট। সরকারি জ্যেষ্ঠ কিছু পদে বয়সেরও বাধা নেই।

সমকাল:
স্বপ্ন থাকা সত্ত্বেও বিপুল অধিকাংশেরই সরকারি চাকরি হয় না। তাদের জন্য আপনার  পরামর্শ কী?

মোহাম্মদ সাদিক: প্রথম কথা হলো- 'লাইফ ইজ বিগার দেন দ্য বিসিএস'। জীবনটা বিসিএস বা সরকারি চাকরির চেয়েও বড়। চাকরিতে আসন সীমিত। সবাইকে ইচ্ছা করলেও সরকারি চাকরিতে নেওয়া সম্ভব নয়। আমরা দেখেছি, যার বিসিএস বা সরকারি চাকরি হয়নি, তিনিও ভালো আছেন। অন্য পেশায় এর চেয়েও বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। এমনকি আজ হয়তো একজন চাকরি পাচ্ছেন না, দেখা গেছে উদ্যোক্তা হয়ে কালই তিনি ১০০০ জনকে চাকরি দিচ্ছেন। সুতরাং এটি বিষয় নয়। আমি মনে করি তারুণ্যের সময়টা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। যে সময়টাকে কাজে লাগিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছেন। সময় অবহেলায় ব্যয় করেননি। তিনি যে পেশায়ই থাকুন, ভালো করবেন। তা ছাড়া সরকারি চাকরিতে কেউ চাইলে একাধিক পদে আবেদন করতে পারেন। একটায় না হোক লেগে থাকলে অন্য আরেকটায় হওয়ার কথা। আর না হলেও হতাশার কিছু নেই।
সমকাল:
দীর্ঘ চাকরিজীবন শেষ করেছেন। অবসরের কোনো পরিকল্পনা আছে?
মোহাম্মদ সাদিক
: আমি সামান্য লেখালেখি করি। অবসরে লেখালেখি ও কিছু গবেষণা করতে চাই। বিশেষ করে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আঞ্চলিক অবহেলিত বিষয়গুলোতে কাজ করতে চাই।
সমকাল:
সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
মোহাম্মদ সাদিক
: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।

ট্যাগঃ , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।