Mahfuzur Rahman Manik
সামাজিক চাপ ও ব্যক্তির আত্মহনন
করোনার মধ্যে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল শিখিয়েছে উদযাপনে পরিমিতিবোধ

 

করোনা সংক্রমণের মধ্যেই এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলো। আর তাই এর প্রভাবও এতে স্পষ্ট। বলা বাহুল্য, সংখ্যার বিচারে তুলনামূলকভাবে শিক্ষার্থীরা এবার ভালো ফল করেছে। পাসের হার যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সর্বোচ্চ গ্রেড জিপিএ ৫। ফলে আপাতদৃষ্টিতে গ্রেড কিংবা পাসের হারে করোনার তেমন প্রভাব পড়েনি। যদিও সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, শিক্ষকরা উদারভাবে খাতা দেখেছেন। উদারতার এ নমুনা দেশে নতুন নয়। তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে এবারের ফল নতুুন কিছু দৃশ্যপট সামনে এনেছে।

দুই.
করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা বাড়ি থেকেই অনলাইনে তার ফল জানতে পেরেছে। আগে দেখা যেত, যে কোনো পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলে প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভালো গ্রেডধারীরা একসঙ্গে আনন্দ-উল্লাস করত। অনেক সময় এ উদযাপনে অতিরঞ্জনও লক্ষণীয়। দুই আঙুলে ভি-চিহ্ন দেখিয়ে শিক্ষার্থীরা যে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে, তা অনেকেই দৃষ্টিকটু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এটা সত্য যে, কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করেছে সেটা নিশ্চয়ই তার সাফল্য। তাতে উদযাপন থাকতেই পারে। তবে সেটি হওয়া চাই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে এবং তা যেন অন্যকে আঘাত না দেয়। যে শিক্ষার্থীটি কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করতে পারেনি তারই সহপাঠীর এমন উদযাপনে সে কষ্ট পেতে পারে।
শিক্ষার্থীদের এমন উদযাপনের একটা কারণ হতে পারে সংবাদমাধ্যম বিষয়টিকে দিনের পর দিন উৎসাহ দিয়ে আসছে। উৎসাহ দিয়ে আসছে এ অর্থে যে, পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরদিনই আমরা সংবাদপত্রের প্রথম পাতাসহ বিভিন্ন পাতায় শিক্ষার্থীদের এসব 'ভি-চিহ্নিত' ছবি দেখে থাকি। অনেক সময় নিজের ছবিটা দেখার জন্যও নিজেকে অনেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে। এসব ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রেও অভিযোগ আছে, কেবল নামিদামি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এবং অনেকক্ষেত্রে মেয়েরাই প্রাধান্য পায়। এ বছর বলা চলে, করোনা সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এমন আরেকটি অতিরঞ্জন আমরা দেখছিলাম ফলের ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্রমধারা করে সেটা ফলাও করে সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা। সেটি বন্ধ হয়েছে। আশা করি, শিক্ষার্থীদের ফল প্রদর্শনের এ প্রবণতাও কমে হয়ে আসবে। তবে এবারের উদযাপন হয়েছে ঘরে ঘরে, অনলাইনে। সংবাদমাধ্যমেও সে রকম পারিবারিক ছবিও প্রকাশ হয়েছে।
তিন.
পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর প্রতিবছরই আত্মহত্যার মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। এবার আত্মহত্যার ঘটনা বেশিই লক্ষণীয়। অনেকের ধারণা, করোনার কারণে এ প্রবণতা বেড়েছে। সংবাদমাধ্যমে যেসব খবর এসেছে তাতে দেখা গেছে, অনেকে জিপিএ ৫ পায়নি বলে আত্মহত্যা করেছে। অনেকে পাস করতে পারেনি বলে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। অনেকে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করতে পারেনি বলে এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে! ৩১ মে ফল প্রকাশের পর থেকে এমন অন্তত ডজনখানেক ঘটনা সংবাদমাধ্যমে এসেছে। করোনা এতে প্রভাবক ভূমিকা পালন করতে পারে এ অর্থে, লকডাউনে ঘরে থাকার কারণে অনেকের মাঝেই বিষণ্ণতা, হতাশা চলে এসেছে। অনেকেই এ পরীক্ষর জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। পরীক্ষার পর অনেকেরই ইচ্ছা থাকে ঘুরেফিরে আনন্দে সময়টা কাটাতে। অনেকে দর্শনীয় স্থান দেখতে বের হয় কিংবা পছন্দের জায়গায় যান। অথচ করোনায় লকডাউনের কারণে ওই সময়টায় অধিকাংশই ছিল ঘরবন্দি। তার ওপর কোনো কোনো শিক্ষার্থীর পরিবার হয়তো অর্থিক সংকটে পড়েছে। সে বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেনি। এর সঙ্গে যখন ফল খারাপের বিষয়টি যুক্ত হয়, দুটি মিলেই শিক্ষার্থীর হতাশা বৃদ্ধি করে থাকতে পারে।
যদিও পরীক্ষার ফলে সৃষ্ট আত্মহত্যার মূল কারণগুলো আমাদের সমাজই সৃষ্টি করেছে। যেখানে বোঝানো হয় পরীক্ষায় জিপিএ ৫ ছাড়া এটা ফলই না; যেখানে অভিভাবক সন্তানের ভালো ফল নিজের সামাজিক স্ট্যাটাসের কারণ মনে করেন; যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জিপিএ ৫-এর জন্য চাপ সৃষ্টি করে; যেখানে জিপিএ ৫ ধারীর ভি-চিহ্নযুক্ত ছবি সংবাদমাধ্যমে বড় করে প্রচার হয়; সেখানে অন্যরা অসহায়। এসব দেখে যারা এ ফল অর্জন করতে পারেনি তারা হয়তো ভাবে, জীবনটা অর্থহীন। এমনিতেই সময়টি বয়ঃসন্ধিকাল। এ সময় না বুঝেও অনেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। যে সময় শিক্ষার্থীর পাশে থাকা উচিত, তাদের সান্ত্বনা দেওয়া উচিত, সে সময় যদি ফলের কারণে কাউকে ভর্ৎসনা করা হয়, তাতে উল্টো পরিণতি হতে পারে। আমাদের মনে রাখা উচিত, জীবন অনেক বড়। একটা ফলের কারণে কেউ খুব বেশি পিছিয়ে যায় না। তার সামনে ঠিক কী অপেক্ষা করছে কেউ জানে না। জগতে যারা বড় হয়েছেন, অন্তত তাদের জীবন সেটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
চার.
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা-পরবর্তী ভর্তি একটা বড় চিন্তা। করোনার কারণে ভর্তি এবার পেছানো হয়েছে বটে। আমরা চাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেই ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হোক। কিন্তু পরবর্তী ধাপে এইচএসসি বা সমমান পর্যায়ে ভর্তি মানেই অর্থের ব্যাপার। অনেকে গ্রামের প্রতিষ্ঠান থেকে ভালো ফল করে পরে রাজধানী বা শহর পর্যায়ে নামিদামি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে চায়। সেখানেও অর্থের বিকল্প নেই। অথচ করোনার কারণে অনেক অভিভাবকের আর্থিক অবস্থা আগের মতো নেই। ফলে ভর্তির ক্ষেত্রে ফি ও অন্যান্য বিষয়ে এবার কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নূ্যনতম ফি নির্ধারণ করে দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো তা মানছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে। এবার যদি এমন কোনো খবর দেখা যায় যে, টাকার কারণে ভর্তি হতে পারছে না কিংবা বোর্ড নির্ধারিত ফি মানা হচ্ছে না, সেটি নিশ্চয়ই দুঃখজনক ব্যাপার হবে।
তবে এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীরা ভাগ্যবান এ অর্থে, করোনায় তাদের পরীক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। অথচ ১ এপ্রিল এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। এখনও সে পরীক্ষার তারিখই ঠিক হয়নি। এবার করোনা আমাদের পরীক্ষার ফল উদযাপনের যে একটা দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে, তা মনে রাখা দরকার। কিন্তু আত্মহত্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। করোনা দুর্যোগে অনেক পরিবারই বিপর্যস্ত। সুতরাং শিক্ষার্থীদের ভর্তিসংক্রান্ত আর্থিক বিষয়টি অবশ্যই চিন্তা করতে হবে।

ট্যাগঃ , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।