পবিত্র রমজানে রোজা পালনের সঙ্গে মসজিদে জামাতে তারাবির নামাজ পড়ার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশে সাধারণত রমজানের এক মাস তারাবির নামাজে অনেক মসজিদেই পবিত্র কোরআন খতম করা হয় বলেই হয়তো এ নামাজের এত গুরুত্ব। কিন্তু এ বছর এমন সময়ে রমজান শুরু হচ্ছে, যখন করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে মানুষ ঘরবন্দি; যখন নিয়মিত ফরজ নামাজ মসজিদে হওয়ার ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নির্দেশনা রয়েছে; যখন পরিস্থিতির নাজুকতায় বিজ্ঞ আলেমগণ ঘরেই নামাজের ব্যাপারে একমত হয়েছেন; যখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য প্রশাসনের তরফ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় মসজিদে তারাবির নামাজের বিষয়টা আলোচনায় এসেছে। রমজান মাসে ইবাদতের গুরুত্ব বিবেচনায় হয়তো ধর্মপ্রাণ মুসলমানের হৃদয়ের আকুতি মসজিদে তারাবি পড়া। কিন্তু পরিস্থিতি যেখানে ভয়াবহ এবং মহামারিতে জীবন-মরণের প্রশ্ন, সেখানে ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেকে সুরক্ষাই অগ্রাধিকার। তারাবির প্রশ্নে এটাই বলা যুক্তিসঙ্গত যথেষ্ট যে, যেহেতু করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি, উল্টো করোনায় আক্রান্ত ও শনাক্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন ব্যাপক হারে বাড়ছে; বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা, এ অবস্থায় ঘরে থাকা জরুরি।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত জুমার নামাজসহ নিয়মিত নামাজের ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের যে নির্দেশনা ছিল, তাই হয়তো বলবৎ থাকবে। বলা বাহুল্য, ইসলামের বিধান অনুসারে তারাবির নামাজের চেয়েও প্রতিদিনের ফরজ নামাজের গুরুত্ব অনেক বেশি। যেখানে ফরজ নামাজই এ পরিস্থিতিতে ঘরে পড়তে হচ্ছে, সেখানে তারাবির নামাজও ঘরে পড়া যেতেই পারে। তারাবির নামাজের ব্যাপারে বুখারি-মুসলিমের একটি হাদিস স্বতঃসিদ্ধ- যে ব্যক্তি ইমান ও আত্মজিজ্ঞাসার সঙ্গে রমজানের রোজা আদায় করবে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ইমান ও আত্মজিজ্ঞাসার সঙ্গে রমজানের রাতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়বে, আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেবেন। এখানে দাঁড়িয়ে নামাজ বলতে অনেকেই তারাবির কথা বলেছেন। পবিত্র মক্কা-মদিনাসহ বিশ্বব্যাপী সেভাবেই গুরুত্বসহকারে জামাতে তারাবি পড়া হয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ও ঝুঁকি বিবেচনায় সেটা কতটা সম্ভব? এমনকি প্রথমে মক্কা ও মদিনার প্রধান দুই মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। পরে সৌদি আরব কর্তৃপক্ষ সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেও সংক্ষিপ্ত পরিসরে সাধারণ মুসল্লি ব্যতীত শুধু ইমাম ও মুয়াজ্জিনসহ কর্মরতদের নিয়ে তারাবির সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশে এখনও সংক্ষিপ্ত পরিসরেই নামাজের জামাত হচ্ছে। রমজানে তারাবিসহ অন্যান্য জামাতও সেভাবেই হতে পারে। আমরা দেখেছি, গত মঙ্গলবার আল্লামা শফীসহ শীর্ষ আলেমরা আল হাইয়াতুল উলাআর প্যাডে এক বিবৃতিতে রমজানে সুস্থ ব্যক্তিদের জুমা, পাঁচ ওয়াক্তের জামাত ও তারাবির জন্য সব মসজিদ খোলা রাখার আহ্বান জানান। মুসল্লিদের দু'জনের মধ্যে অন্তত দুই ফুট পরিমাণ জায়গা ফাঁক রেখে দাঁড়ানোসহ ১৪টি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে মসজিদ উন্মুক্ত করে দেওয়ার মতামত দিয়েছেন তারা। (পরে অবশ্য আলেমদের মতামতের আলােকে সতর্কতামূলক নির্দেশনা দিয়ে মসজিদ খুলে দেয়া হয়েছে) ।
তবে ইবাদতের ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান যে লক্ষ্য- মহান আল্লাহর নির্দেশ মানা; তাঁর সন্তুষ্টি ও নেকি অর্জন; গুনাহ মাফ ও জান্নাত লাভ সেটি ঘরে বসে ইবাদতের মাধ্যমেই সম্ভব। তারাবির ক্ষেত্রে হাদিসে যে ইমান, ইখলাস ও আত্মজিজ্ঞাসার কথা বলা হয়েছে, ব্যক্তিগতভাবে তা পড়ার ক্ষেত্রেও যদি এসব ঠিক থাকে তাতে আশা করা যায়, সওয়াবে কোনো কমতি হবে না। সবাই ঘরে একাকী ২০ রাকাত বা আট রাকাত যেভাবে তারাবি পড়েন- তা যেন ধীরে-সুস্থে ও বিনীতভাবে আদায় করা হয়। তারাবিতে আমাদের দেশে যেভাবে তাড়াহুড়ো করে কোরআন তেলাওয়াত ও অন্যান্য তাসবিহ আদায় করা হয়, তা সুন্নতসম্মত হতে পারে না।
আমরা জানি, প্রতিবছর দেশব্যাপী মসজিদগুলোতে তারাবির জন্য হাফেজে কোরআনদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এবার সামষ্টিকভাবে তারাবি না হলে অনেক হাফেজ সে সুযোগ হারাতে পারেন। কিন্তু এখন যেভাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নির্দেশনা মেনে ৫-১০ জন নিয়ে জামাত হচ্ছে মসজিদগুলোতে, সেভাবে জামাত হলে হাফেজদের নিয়োগে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বৃহস্পতিবার ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, একেকটি মসজিদে দু'জন হাফেজসহ মোট ১২ জন তারাবি পড়তে পারবেন। এটা গ্রহণযোগ্য সমাধান। আর অন্যান্য সময়ে সবাই মিলে যেমন হাফেজদের সম্মানী দেওয়া হতো, এবার সেখানে সরকার প্রণোদনা দিতে পারে। এমনকি মসজিদ কমিটি মিলে সমাজের বিত্তবানরাও তাদের সম্মানীর বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে।
মূল বিষয় হলো, পবিত্র রমজান ইবাদতের মাস। এবার ঘরে থেকে ইবাদতে অধিক হারে মনোনিবেশ করার সময় ও সুযোগ সবাই পাচ্ছেন। এ সুযোগ একাকী কিংবা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কাজে লাগানো যায়। তারাবির নামাজও এর বাইরে নয়। ঘরে থেকেই ফরজ, সুন্নত, নফলের মতো তারাবির নামাজ পড়লেও আগের চেয়ে সওয়াবে কমতি হওয়ার কথা নয়। নিজে কোরআন পড়লে কিংবা ডিজিটাল ডিভাইসে শুনলে কোরআন শোনার সওয়াবও পাওয়া যাবে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি বলে নিজের ও অন্যের সুরক্ষায় এটিই এখনকার ভালো বিকল্প।