বঙ্গোপসাগর আমাদের এক আবেগের জায়গা, বিশেষ করে সমুদ্রসীমার বিরোধ মিটে যাওয়ার পর আমাদের স্বপ্নের ডালপালা আরও গজাচ্ছিল। বঙ্গোপসাগরের তলদেশ গ্যাস, পেট্রোলিয়ামসহ নানা খনিজসম্পদে ভরপুর। আমাদের মাছের জোগানের উল্লেখযোগ্য অংশ আসছে বঙ্গোপসাগর থেকেই। আমাদের নদীগুলোর মতো বঙ্গোপসাগরেও দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে। নদী দূষণের মতো সাগর দূষণেরও অন্যতম কারণ প্লাস্টিক। প্রতিদিন যে বর্জ্য তৈরি হয়, তার প্রায় ১০ ভাগ প্লাস্টিক। এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী পাঁচশ' বিলিয়ন পল্গাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে। যার মধ্যে প্রায় ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সমুদ্রে পতিত হয়। এখানেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ফলে সমুদ্রচারী পাখি ও সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে। সাগরের প্রতিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। আমাদের কোনো না কোনো স্থানে ফেলে দেওয়া চিপসের প্যাকেট কিংবা প্লাস্টিকের বোতল শেষ পর্যন্ত তার গন্তব্য হিসেবে খুঁজে নিচ্ছে সমুদ্রকে।
তাছাড়া চট্টগ্রামে সমুদ্র উপকূলীয় জাহাজ ভাঙা শিল্পের ইয়ার্ডগুলো থেকে হেভি মেটাল, জ্বালানি তেলের বর্জ্যসহ নানা ক্ষতিকর পদার্থ সমুদ্রের পানিতে মিশছে, যা সামুদ্রিক মাছের প্রজনন, মাছের পোনার বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন জাতের মাছের বংশ ধ্বংসে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। সেই সঙ্গে সমুদ্রের মাছেরা সমুদ্রতলের যেসব উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল, সেসব উদ্ভিদও ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তার ওপর মাছ ধরার জাহাজ ও ছোট যান্ত্রিক নৌকাগুলো বঙ্গোপসাগরে আইএমও কনভেনশন লঙ্ঘন করে প্রতিনিয়ত সমুদ্রের পানিতে নানা বর্জ্য ফেলছে। এসব কারণে সাগর থেকে আহরিত মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। যেখানে ২০১০-১১ অর্থবছরে বঙ্গোপসাগর থেকে ৫৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন টন সামুদ্রিক মাছ আহরণের তথ্য মিলে, সেখানে বর্তমানে সামুদ্রিক মাছ আহরণের বার্ষিক পরিমাণ ২০-৩০ মিলিয়ন টনে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলংকা বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী দেশ। সমুদ্র দূষণে এসব দেশেরও দায় রয়েছে। জার্মানির একটি গবেষণা সংস্থা বলছে, বিশ্বের মাত্র ১০টি নদীর মাধ্যমে ৭৫ শতাংশ সমুদ্র দূষণ হয়, এসব নদীর অধিকাংশই এশিয়ায়। এসব নদীতে প্লাস্টিকের পরিমাণ ৫০ শতাংশ কমানো গেলে সারাবিশ্বে প্লাস্টিক দূষণ ৩৭ শতাংশ কমবে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের নদীগুলোকে দূষণমুক্ত করা গেলে তার প্রভাব সমুদ্রেও পড়বে।
গত বছরের শুরুতে ইংল্যান্ডের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান 'প্লাস্টিক পলিউশন ব্লাইটস বে অব বেঙ্গল' অর্থাৎ প্লাস্টিক দূষণ বঙ্গোপসাগরকে বিপর্যস্ত করছে শিরোনামে এক ফটো ফিচার করে। তাতে বলা হয়, প্রতিদিন ভারতে ৬ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর উল্লেখযোগ্য অংশ তামিলনাড়ূ রাজ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। প্লাস্টিক বর্জ্য পড়ে সেখানকার বঙ্গোপসাগরের কয়েকটি জায়গার দুরবস্থা ওই প্রতিবেদনের ছবিগুলোতে ফুটে ওঠে।
মঙ্গলবার সমকালে 'সাগরে দূষণ রোধে সহযোগিতা বাড়াবে বাংলাদেশ-ভারত' শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। খবরটি দুই দেশের কোস্টগার্ডের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের বৈঠকের সিদ্ধান্ত। উভয় দেশই সাগরে পরিবেশ দূষণ রোধে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। এটি ইতিবাচক ও যথাযথ সিদ্ধান্ত। কারণ সাগরের দূষণ কমাতে কেবল একটি দেশের পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়। এ জন্য প্রত্যেক দেশকেই এগিয়ে আসতে হবে।