Mahfuzur Rahman Manik
তিস্তা ইস্যুতে মমতার ওপর চাপ বাড়ছে
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশে অচল হয়ে পড়েছে তিস্তা সেচ প্রকল্প

মূল : রোমিতা দত্ত

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যকার তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির কোনো গতিই হয়নি। কলকতার একটি পাঁচতারা হোটেলে শেখ হাসিনা ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক ঘণ্টার একান্ত বৈঠককে অফিসিয়ালি 'উষ্ণ, বন্ধুত্বপূর্ণ ও আন্তরিক' বলা হলেও বাংলাদেশের মানুষের কানে তা অন্য যা কিছু শোনাক অন্তত মধুর শোনাবে না।

যদিও শেখ হাসিনা তার দেশের জাতীয় কবির নামে বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার (ডিলিট) উপাধি নিয়ে দেশে ফিরেছেন। কিন্তু তিনি তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে কোনো আশার বাণী নিয়ে যেতে পারেননি। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবারও তিস্তার বিষয়ে আলোচনা এড়িয়ে যেতে পেরেছেন; তারপরও শেখ হাসিনা তিস্তার বল মমতা কোর্টে ফেলেছেন বলে বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ওপর চাপ বাড়ছে।

এ বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। বিরোধী দল বিএনপি ইতিমধ্যেই তিস্তার পানি না পাওয়ার বিষয়টিকে একটি বড় নির্বাচনী ইস্যু বানিয়েছে, যেটি হাসিনা সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে। আওয়ামী লীগের ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণেও এ ইস্যুতে দলটি সমালোচিত হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কারণেই বিএনপি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে তিস্তা নিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে।

শেখ হাসিনাও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পূর্বের সব বৈঠকে বিষয়টির ওপর বারবার জোর দিয়েছেন; যেহেতু বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি বিরাট এলাকাজুড়ে তিস্তার পানি প্রয়োজন এবং পানি না পাওয়ার কারণে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০১১ সালে তিস্তা চুক্তি প্রায় সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পানির প্রশ্নে বেঁকে যান। মমতার পানি না দেওয়ার মধ্যেও রাজনীতি রয়েছে। তার ভাবনায় হয়তো পশ্চিমবঙ্গের তিস্তা এলাকার কৃষকও রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশে অচল হয়ে পড়েছে তিস্তা সেচ প্রকল্প। রংপুর অঞ্চল মরুকরণ হচ্ছে। মৎস্য চাষ ও নদীভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থা অদৃশ্য হয়ে গেছে।

২০১১ সাল থেকেই মমতার কারণে তিস্তা চুক্তি মুলতবি হয়ে আছে। ভারতে জাতীয় নির্বাচনের প্রায় বছরখানেক বাকি। এ অবস্থায় আসলে মমতা চুক্তি করতে অনিচ্ছুক। কারণ, এখন চুক্তিটি করলে তা তার দলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

২০১৭ সালে শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ব্যাপক জোর দেন; এমনকি বাংলাদেশের তরফে তিস্তাই ছিল প্রধান দাবি; আগত নির্বাচনে যেটি অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সামনে আসবে।

যা হোক, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহ সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা চুক্তি আটকে রেখেছেন। সোমবারও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ দিল্লিতে সাংবাদিকদের কাছে স্পষ্ট করেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সম্মতি ছাড়া তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এদিকে মমতা আবার বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যকার অভিন্ন কিছু নদী নিয়ে কথা বলেছেন। তিস্তার বদলে জলঢাকা ও তোরসাসহ উত্তরাঞ্চলে প্রবাহিত তিন-চারটি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনার কথা বলেছেন। তিনি ওই দুই বা তিন নদী থেকে পানি এনে তিস্তার পানি সংকট মেটাতে চান। তার কারণ দেখিয়েছেন তিস্তায় পানি সংকট।

এ অবস্থায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ভবনে মোদি ও হাসিনার সে বৈঠক এ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, সেখানে মমতাও ছিল আলোচনার বিষয়।

শেখ হাসিনা তার ভারত সফরে বারবারই ভারতের অবদানের কথা বলছিলেন, বিশেষত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর অবদানের কথা, কীভাবে ভারতের মানুষ সে সময় তার দেশের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়- তাও শেখ হাসিনা বলেছেন। এসবের দ্বারা শেখ হাসিনা আসলে এ কথা বোঝাতে চাইছেন যে, এখনও ভারত যেন তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করে সে সময়ের মতো উদারতার পরিচয় দেয়।

হাসিনা ও মমতার মধ্যকার বৈঠকে তাদের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছে, সেটা তাদের চেহারা দেখে আমরা অনুমান করতে পারি। তবে বৈঠক শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। মমতার ভাষায়- 'এমনকি হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, তখনও তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল। আমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক রয়েছে, প্রয়োজনের সময় আমরা পরস্পর এগিয়ে এসেছি।'

দুই প্রতিবেশীর মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে তিনি আরও বলেন, তিনি উভয়ের মধ্যে কোনো সীমানায় বিশ্বাসী নন। বাংলাদেশে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কিনা সে প্রশ্নে মমতা বলেন, দরজা সবসময়ই খোলা ছিল। 'আমরা চেয়েছি তারা সবসময় এখানে আসুক, আর আমরাও সেখানে যাব, যখনই প্রয়োজন মনে করি।'

শুনতে ভালোই শোনায়, এখন আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই সময় তার বন্ধুত্বপূর্ণ কথার প্রতিফলন।

ট্যাগঃ , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।