Mahfuzur Rahman Manik
জলবায়ু : উপকূলবাসীর পাশে থাকুন
ফেব্রুয়ারী 25, 2018

মূল : কাসিয়া পাপরোকি

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের কলাম লেখক নিকোলাস ক্রিস্টফ ১৯ জানুয়ারি প্রকাশিত তার কলামে লিখেছেন, সেখানে সমুদ্রস্তর বেড়ে যাওয়ায় উপকূলবর্তী এলাকা তলিয়ে যাওয়ার ভয়ে কৃষকরা জোর করে অল্পবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশের কল্পিত এই চিত্র অত্যন্ত গতানুগতিক। এই আখ্যানের মূল বিষয় হলো : সমুদ্রস্তর বেড়ে যাওয়ায় ভূমি তলিয়ে যাচ্ছে, সেখানকার হতভাগা ও মরিয়া বাসিন্দারা তাদের ভূমি ও আবাস হারিয়ে যেতে দেখছে, ফলে ছোট্ট এ দেশটিতে লাখো 'জলবায়ু শরণার্থী' হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, এর প্রভাব বিশ্বের অন্যান্য জায়গার মতো বাংলাদেশের ওপরও পড়ছে; তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর প্রভাব যেমন উপকূলবর্তী বাংলাদেশিদের ওপর পড়ছে, তেমনি পড়ছে উপকূলবর্তী মার্কিন ম্যানহাটনের ওপরও। উভয় এলাকার মানুষই এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে রয়েছে।
নিকোলাস ক্রিস্টফ যেটা বলছেন, বাংলাদেশ জলবায়ুর অত্যন্ত ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ধরনের পরিভাষা বরং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের 'ঝুঁকিপূর্ণ দেশ', যাদের অভিবাসীদের তিনি চান না; তার সে কল্পিত পরিভাষার সঙ্গে মিলে যায়। এমনকি ক্রিস্টফের বর্ণনা মানবহিতৈষী হলেও সেখানে বরং একটি দেশের শক্তিহীনতা, অক্ষমতা, নির্ভরশীলতা ও ব্যর্থতার চিত্রই ফুটে ওঠে।
এটা হয়তো ঠিক যে, এ ধরনের বর্ণনার বাস্তব কারণও রয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী মানুষের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে এবং তারা এর ঝুঁকি মোকাবেলা করছে। এখন তাদের বসবাসের জীবন ধারণের উপায়-উপকরণের পরিবর্তে প্রয়োজন কীভাবে এ ঝুঁকির অভিযোজন করা যায়, সে ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতা। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় আমি দেখিয়েছি, এ অভিযোজনের বিষয়াদি আসলে উন্নয়নের একটি দূরদর্শী পরিকল্পনার ওপর নির্ভরশীল। যেখানে নগরায়ন ও রফতানির বিষয়টি প্রত্যাশিত ও অনিবার্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ও ক্রিস্টফের ব্যাখ্যায় দীর্ঘদিনের বৈদেশিক পদক্ষেপকেও অগ্রাহ্য করা হয়। বরং ইতিহাস বলছে, জলবায়ু সংকট কখনোই অনিবার্য ছিল না। যেখানে ১৯৬০-এর দশকে মার্কিন ও ডাচ প্রকৌশলীরা বাংলাদেশের উপকূলজুড়ে একটি বিশাল বাঁধ তৈরি করে, যার উদ্দেশ্য ছিল মৌসুমি বন্যা থেকে কৃষিজমি রক্ষা করে চালের উৎপাদন বাড়ানো। সে সময় এটি ছিল উন্নয়নের একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প। দুঃখজনকভাবে বিদেশি প্রকৌশলীদের তৈরি এই প্রকল্পটি ছিল বাংলাদেশের আবহাওয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত। এই ত্রুটিপূর্ণ প্রকল্পের কারণে ব্যাপক জলাবদ্ধতা তৈরি হয়, জমির পরিমাণ কমে যায়। এরপর ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশের শহুরে অভিজাতরা এসব জলাবদ্ধ ভূমিকে ব্যবহারের এক সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যায়। তারা সেখানে ধানের পরিবর্তে চিংড়ি চাষ শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে চিংড়ির চাহিদা বাড়ায় ইউএসএইড ও বিশ্বব্যাংকের মতো বৈদেশিক সংস্থার সহযোগিতায় হিমায়িত চিংড়ি শিল্প দ্রুত বিকশিত হয়। একই সঙ্গে এর সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাবও দ্রুততর হয়। মাটির লবণাক্ততার ফলে স্থানীয় কৃষি উৎপাদনে ধস নামে। ফলে অগণিত কৃষক ও দিনমজুর যারা কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল, তারা কাজ হারায়।
আজ অনেক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই কৃষির উৎপাদন আর সম্ভব নয়। অথচ তারা চিংড়ি চাষের বিষয়টির কথা বলেন না। আর ফলে উপকূলবর্তী মানুষের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় যে অভিযোজন কৌশল নেওয়া হচ্ছে তা কাজে আসছে না। এরপরও বাংলাদেশের জলবায়ু নিয়ে বৈশ্বিক ধারণা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবেই কল্পনা করা এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এতে ভবিষ্যৎ জলবায়ু সংকট তো কমছেই, বরং নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে।
সে অঞ্চলের কৃষকরা বিচিত্র ও কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করলেও কিছু মানুষ সেখানে ভবিষ্যতের অন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে- যেটি বৈশ্বিক অলীক স্বপ্নের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভূমিহীন কৃষকরা এখন চিংড়ি উৎপাদন বন্ধ করে তাদের কৃষি জমি ফিরিয়ে দিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করছে। তাদের প্রচেষ্টা এটা স্পষ্ট করছে যে, বাংলাদেশের উপকূলবর্তী মানুষ আসলে অসহায় নয়। তাদের উদ্যম বলছে, ম্যানহাটনের ধনী বাসিন্দাদের মতোই তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। ফলে আমাদের সংহতিই তাদের প্রাপ্য সহানভূতি নয়। জলবায়ুর ন্যায্যতার দাবিও এ সংহতি।

ট্যাগঃ , , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।