Mahfuzur Rahman Manik
'বঞ্চনার কারণেই বাংলাদেশের জন্ম'
জানুয়ারী 18, 2018

মূল : বাবর আয়াজ

নওয়াজ শরিফ একবারে সত্যবাদী বা বিশ্বস্ত না-ও হতে পারেন; তবে পূর্ব পাকিস্তানের বিভক্তি ও বাংলাদেশের জন্মের ব্যাপারে তিনি পাকিস্তানকে যে আত্মানুসন্ধানের কথা বলেছেন, তা ভুল বলেননি। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার পরিবর্তে কিছু উগ্র দেশপ্রেমিক সংবাদমাধ্যমে তাকে একহাত নিয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের বোকামির কারণেই শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন- নওয়াজের এ কথায় বেশ চটেছেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) এক জ্যেষ্ঠ নেতা।

আমিও নওয়াজ শরিফের বক্তব্য সমর্থন করে বলছি, এখনি সত্য স্বীকারের উপযুক্ত সময়, সেটি যতই তিক্ত হোক না কেন।

বাংলাদেশের জন্ম কেবল পূর্ব পাকিস্তানে আট মাসের সামরিক যুদ্ধের ফল নয়; বরং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে উপনিবেশস্বরূপ যে আচরণ করেছে, তারই ফল। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ভারত সমর্থন করে, এর মাধ্যমে তারা দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতা বিশ্বের কাছে দেখানোর সুযোগ পায়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্ট করেন। এরপর ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, বাংলা প্রদেশের ভাষা হতে পারে বটে; তবে আমি স্পষ্ট করে বলছি, অন্য কোনো ভাষা নয়, উর্দুই হতে পারে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এটি বাঙালিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। কারণ এতে তারা পাঞ্জাবি বা পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যারা ভালো উর্দু বুঝত, তাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে।

বাঙালি অবশেষে ভাষার অধিকার আদায় করে। পূর্ব পাকিস্তানিদের একটি 'শহীদ মিনার' দেওয়ার পর শেষ পর্যন্ত ১৯৫৪ সালে সংবিধানের তৃতীয় খসড়ায় বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে মেনে নেওয়া হয়। একই সময়ে ইংরেজিকে '২০ বছরের জন্য দেশের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়' (মেহেরুন্নিসা আলী, ১৯৬৬)।

এবার আমরা কিছু বৈষম্য দেখব। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত গোটা পাকিস্তানে সরকারি খরচ ছিল ৩০.৯৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ হয় ২১.৪৯ বিলিয়ন ডলার, মানে ৬৯ শতাংশেরও বেশি। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল গোটা পাকিস্তানের জনসংখ্যার ৫৫ ভাগ। এ অর্ধেকেরই বেশি জনসংখ্যার জন্য বরাদ্দ হয় মাত্র ৩০.৪৫ শতাংশ।

সম্পদের এ বণ্টন আবার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আয়ের সঙ্গেও অসঙ্গতিপূর্ণ। পুরো ২৪ বছর ধরে পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত থাকত। এক জার্নালে 'হোয়াই বাংলাদেশ' নামে ভিয়েনার একদল গবেষক পাকিস্তানের সরকারি নথি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দেখিয়েছেন, কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান শোষণ করেছিল। তারা দেখিয়েছেন, 'বৈদেশিক বাণিজ্যে পূর্ব পাকিস্তান পুরো দেশের মধ্যে ৫৯ শতাংশ রফতানি করত; কিন্তু আমদানি করত মাত্র ৩০ শতাংশ। একই সময় বৈদেশিক আয়ের ৪১ শতাংশ আয় করত পশ্চিম পাকিস্তান; কিন্তু তার জন্য বরাদ্দ ছিল পুরো আয়ের ৭০ শতাংশ।

আবার পূর্ব পাকিস্তানের আয়ের টাকা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিল্পকারখানায় বিনিয়োগ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি পণ্যের একটি নিরাপদ বাজার। পশ্চিম পাকিস্তান ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ৫.২৯ বিলিয়ন রুপির পণ্য রফতানি করে; অথচ আমদানি করে ৩.১৭ বিলিয়ন রুপির পণ্য।

আবার বৈদেশিক সাহায্যের প্রায় ৮০ শতাংশই পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভোগ করত। ভিয়েনা গ্রুপের মতে, প্রথম ২০ বছরে উন্নয়নের জন্য আসা সাহায্যের ৭৭ ভাগই পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ হয়। পূর্ব পাকিস্তানের পাট ও কাগজ শিল্পে বিনিয়োগের অধিকাংশের মালিকানাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর। পূর্ব পাকিস্তান ছিল তাদের ৫ কোটিরও অধিক জনসংখ্যার বাজার। এ কারণে তাদের উপনিবেশ পূর্ব পাকিস্তানকে হারানোর পর ১৯৭২ সালে পাকিস্তানকে তাদের মূদ্রার ১৩৫ শতাংশ মূল্য হ্রাস করতে হয়েছিল। তখন পাকিস্তানের টেক্সটাইল ও ভোক্তা শিল্পে ব্যাপক ধস নামে।

পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্তও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কারণ সরকারিতে তাদের অংশ ছিল খুবই নগণ্য। যেমন- ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় কর্ম কমিশনের চাকরিতে ৫৪ শতাংশের মধ্যে বাঙালি ছিল ১৬ শতাংশ। বৈদেশিক চাকরিতে ১৫ শতাংশ আর সেনাবাহিনীতে ১৭ জন জেনারেলের মধ্যে বাঙালি ছিল মাত্র একজন। পিআইএ'তে যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের কর্মচারী ছিল ২৮০ জন, সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ৭০০ জন।

এসব বিষয় মাথায় রেখে, কীভাবে বাংলাদেশ বিষয়ে ভাবনায় নওয়াজ শরিফের আহ্বানকে দোষারোপ করা যায়। বরং নিঃসন্দেহে এটি ভালো যে, পাঞ্জাব থেকে আসা একজন নেতা এসব বিষয় সামনে আনছেন, যেখানে পাঞ্জাবে এগুলো নিষিদ্ধ বিষয়।

নাৎসি সরকারের শাসনামলে ইহুদি ও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হত্যার জন্য জার্মানরা কেবল ক্ষমা প্রার্থনাই করেনি বরং জাদুঘরও স্থাপন করেছে, যাতে তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বলতে পারে অতীতে তারা কী ভুল করেছে। আমরাও কি পূর্ব পাকিস্তানে ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে পারি না?

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।