Mahfuzur Rahman Manik
হোয়াইট হাউসে টিকতে পারি আট দিন
ফেব্রুয়ারী 26, 2017

মূল: রুমানা আহমেদ

আমি ২০১১ সালে কলেজ থেকে বের হয়েই হোয়াইট হাউসে এবং ঘটনাচক্রে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে কাজের জন্য নিযুক্ত হই। আমার কাজ দেশের স্বার্থ রক্ষা করা। পশ্চিম উইংয়ে কেবল আমিই ছিলাম হিজাবি, ওবামা প্রশাসন সবসময়ই আমাকে স্বাগত জানাত, যেন আমি তাদেরই একজন।
অধিকাংশ আমেরিকান মুসলমানের মতো আমিও ২০১৬ সালটা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে মুসলমানদের প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিদ্বেষ দেখে কাটিয়েছি। তা সত্ত্বেও কিংবা এ কারণেই আমি চিন্তা করেছিলাম ট্রাম্প প্রশাসনে আমার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের স্টাফ হিসেবে থাকাই উচিত। যাতে নতুন প্রেসিডেন্ট ও তার সহকর্মীদের ইসলাম ও আমেরিকার মুসলিম নাগরিকদের সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে পারি।
কিন্তু আমি টিকে ছিলাম মাত্র আট দিন।
যখন ট্রাম্প সাতটি মুসলিমপ্রধান দেশ ও সব সিরিয়ান শরণার্থীর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন, তখন আমি জানতাম, আমি এখানে আর থাকতে পারব না এবং সে প্রশাসনের হয়ে কাজ করতে পারব না, যারা আমাকে ও আমার মতো মানুষদের নাগরিক হিসেবে নয় বরং হুমকি হিসেবে দেখে।
একই অফিসের হিসেবে আমি ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের জ্যেষ্ঠ যোগাযোগ উপদেষ্টা মাইকেল অ্যান্টনকে আমার পদত্যাগের কথা জানালাম। তিনি বিস্মিত হয়ে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞেস করেন, আমি পুরোপুরিভাবে সরকারকে ত্যাগ করছি কি-না? তারপর তিনি সতর্কতার সঙ্গে নীরব ছিলেন। আর কারণ জানতে চাননি।
যাই হোক আমি তাকে বললাম, আমাকে চলে যেতে হবে, কারণ প্রতিদিন এই দেশের সবচেয়ে ঐতিহাসিক ভবনে এমন এক প্রশাসনের অধীনে কাজ করা আমার জন্য অপমানজনক। যে প্রশাসন একজন আমেরিকান ও একজন মুসলিম হিসেবে আমার স্বার্থের বিপক্ষে এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করে। আমি তাকে বললাম, এই প্রশাসন তো গণতন্ত্রের নীতি ও বিশ্বাসের ভিতকেই আক্রমণ করে বসেছে।
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, কিছুই বলেননি।
আমার মা-বাবা ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী তাদের সন্তানদের জন্য সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে তাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমার মা প্রথমে ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি তার ডে কেয়ার ব্যবসা চালু করেন। আমার বাবা ব্যাংক আমেরিকায় গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতেন এবং তার হেডকোয়ার্টারে তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে পদোন্নতি পান। আমেরিকার স্বপ্ন ধারণ করে আমরা এমনকি অনেক কমিউনিটির সেবামূলক প্রকল্পে কাজ করি। আমার বাবা পিএইচডিও শুরু করেছিলেন, কিন্তু ১৯৯৫ সালে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান।
১২ বছর বয়স থেকেই আমি হিজাব পরিধান করা শুরু করি। আমার পরিবার তাতে উৎসাহ দিত। একই সঙ্গে হিজাব ছিল আমার সব সময়ের পছন্দ। এটা ছিল আমার কাছে বিশ্বাস, পরিচয় এবং স্বাভাবিক বিষয়। নাইন-ইলেভেনের পর সব কিছুর পরিবর্তন ঘটেছিল। স্কুলে আমার তখন এক দুঃসহ সময় কাটছিল। লোকেরা আমাকে 'সন্ত্রাসী' হিসেবে চিহ্নিত করত এবং বলত, তুমি তোমার দেশে চলে যাও।
আমার বাবা ইসলামী ধর্মগ্রন্থ সমর্থিত একটি বাংলা প্রবাদ শিখিয়েছেন, 'যখন কেউ তোমাকে নিচে ফেলে, তুমি উঠে গিয়ে তাকে ভাই বলে সম্বোধন করো।' আমি আমার জীবনে এবং ক্যারিয়ারে সবসময় যে গুণগুলো লালন-পালন করি তা হলো, শান্তি, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সম্মান, ক্ষমা এবং মর্যাদা।
আমি কখনোই সরকারি চাকরি করতে চাইনি। আমি ছিলাম তাদেরই একজন, যারা মনে করত, সরকার স্বভাববশতই দুর্নীতিগ্রস্ত ও ব্যর্থ। তবে ওবামা প্রশাসনে কাজ করে আমি প্রমাণ পেয়েছি, এ ধারণা ভুল। তুমি যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত নও, তার ব্যাপারে জানা অসম্পূর্ণ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমি এখনও প্রেসিডেন্ট ওবামার দ্বারা অনুপ্রাণিত। আমি ২০১১ সালে জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর হোয়াইট হাউসে যোগ দিই। আমি তখন সেখানে ইন্টার্ন করি। ২০১২ সালে আমি পশ্চিম উইংয়ে পাবলিক অ্যানগেজমেন্ট অফিসে কাজ শুরু করি। তখন আমি নানা কমিউনিটির সঙ্গে, বিশেষত মুসলিম কমিউনিটির সঙ্গে স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করি। ২০১৪ সালের প্রথম দিকে উপজাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বেন রোডস আমাকে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে একটি পদে যোগদানের জন্য বলেন। তারপর থেকে আমি সেখানে কাজ করি।
২০১৫ ও ২০১৬ সাল পুরোটা জুড়ে আমি ট্রাম্প স্টাইলের জাতিবিদ্বেষ, মুসলিম ভীতি ছড়ানো প্রচার লক্ষ্য করি। অথচ এ রকমই প্রচারের মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে ওবামা বাল্টিমোরে একটি মসজিদ পরিদর্শন করেন এবং সেখানকার জনসাধারণকে বলেন, আমরা সবাই মিলেই একটি আমেরিকান পরিবার। যখনই আমাদের কোনো অংশ নিজেদের ভিন্ন ভাবে, তখনই তা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। এটি প্রমাণিত যে, আমেরিকান জাতি সংগ্রাম, সমবেদনা ও সবাইকে নিয়ে উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে। যার ফলে আমার মা-বাবা এখানে এসেছেন। এর ফলেই আমি আমার সাবেক স্কুল শিক্ষার্থীদের বলেছি, তারা এই জাতিরই অংশ, এই দেশ তাদের সবাইকে নিয়ে মহান।
ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।