Mahfuzur Rahman Manik
গভীর সমুদ্রবন্দর : বিনিয়োগে আগ্রহ নানা দেশের
Chittagong-Port
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর

মূল: ওয়েড শেপার্ড

বাংলাদেশের একটি গভীর সমুদ্রবন্দর প্রয়োজন। দেশটি বিশ্বের অন্যতম দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ। এ বছর জিডিপি বেড়ে ৭.১ শতাংশ হওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। গোলডম্যান সাক্সের একুশ শতকে বিকাশমান অর্থনীতির 'নেক্সট ইলেভেন' তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানির দেশ বাংলাদেশের রফতানি খাত দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে এবং ২০২১ সালের মধ্যে রফতানির পরিমাণ বার্ষিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। পর্যাপ্ত সামুদ্রিক অবকাঠামো না থাকা সত্ত্বেও এ হলো বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।

স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও বাংলাদেশ একটি নতুন বন্দর নির্মাণ করতে পারেনি। বর্তমানে বার্ষিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য দেশটির বিদ্যমান দুটি সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর দিয়ে পরিচালিত হয়। কিন্তু উভয় বন্দরই এত অগভীর যে, বড় কনটেইনার সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে বড় জাহাজে পণ্য তুলে দিতে ছোট জাহাজে নিয়ে আসতে হয়। এতে যেমন প্রতিদিন ১৫ হাজার ডলার অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়, একই সঙ্গে বন্দরের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যায়।

বাংলাদেশের জন্য এই সমস্যার সমাধান খোঁজা সমস্যাসংকুল হিসেবেই প্রমাণ হয়েছে। তবে এটা এ জন্য নয় যে, সেখানে তাদের উপায় নেই অথবা বিনিয়োগকারী সংকট কিংবা আন্তর্জাতিক সাপোর্টের অভাব। বরং ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বিপরীত; অনেকগুলো প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিশালী পক্ষ নানা পরিকল্পনা চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। এটি বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিক খেলার দাবার ঘুঁটিতে পরিণত করেছে। একবার এদের সঙ্গে এই প্রকল্প আবার অবস্থান পরিবর্তন করে অন্যদের সঙ্গে আরেক প্রকল্প পরিকল্পনা। বস্তুত বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ নিয়ে চীন, জাপান ও ভারত বলা চলে প্রকাশ্য প্রতিযোগিতাই লিপ্ত।

বাংলাদেশ ছোট দেশ হলেও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের একেবারে বগলে ও ভারত মহাসাগরের ডানে এর অবস্থান। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বিশ্বের ২৫ শতাংশ ভূমি রয়েছে। এখানে ৪০ শতাংশ তেল ও গ্যাস মজুদ এবং এখানে বিশ্বের তিন ভাগের এক ভাগ লোক বাস করে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম ও গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচলের পথ। মধ্যপ্রাচ্যের অপরিশোধিত তেল পূর্ব এশিয়ায় সরবরাহ এ পথে। ঢাকা এখনও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক কাদামাটির বলের মতোই নমনীয়, যদিও এটি সমানভাবে পূর্ব ও পশ্চিমা বিশ্বের আগ্রহের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের ক্ষমতা-দ্বন্দ্বে ভারসাম্যের দিক থেকে বাংলাদেশ মুখ্য হয়ে উঠছে।

এই ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চরম আকার ধারণ করেছে, যখন বাংলাদেশ তার প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য জায়গা নির্ধারণ করছে ও এর অর্থ জোগানদাতা খুঁজছে। কারণ, কয়েকটি শক্তি তার স্বার্থ নিশ্চিত করা ও বঙ্গোপসাগরে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য ব্যাপক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চারটি সম্ভাব্য স্থান হচ্ছে_ চট্টগ্রাম, সোনাদিয়া, মাতারবাড়ী ও পায়রা।

চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর :বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব বাঁকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে অবস্থিত সমুদ্রবন্দরটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর। বন্দর কর্তৃপক্ষের হিসাবমতে, দেশের ৯৮ শতাংশ কনটেইনার কার্গো ও মোট কার্গোর ৯২ শতাংশ এ বন্দর দিয়ে চলাচল করে। এ বন্দরের সমস্যা হলো, এর গভীরতা ৯.২ মিটার, আধুনিক কনটেইনারশিপের জন্য যথেষ্ট গভীর নয়। কিন্তু এর প্রসারণ সময় ও ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। এ সমস্যার সমাধান হিসেবে বঙ্গোপসাগরের চট্টগ্রামের পতেঙ্গা উপকূলে ১২০০ একরের ওপর একটি নতুন বন্দর নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু তাও টেকনিক্যালি গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য যথেষ্ট নয়। গভীরতা ধরা হয় ১৩ থেকে ১৪ মিটার। অথচ বড় শিপ বন্দরে আসার জন্য ১৫ মিটার গভীরতা প্রয়োজন।
২০১০ সালে চীন চট্টগ্রাম বন্দরের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের জন্য আগ্রহ ব্যক্ত করে। সে সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনের আগ্রহকে বড় অর্জন হিসেবে উল্লেখ করেন। এই পরিকল্পনার সঙ্গে চীনের আগ্রহ ইউনান প্রদেশ দিয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত স্থলপথে একটি করিডোর নির্মাণ। এর দ্বারা চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের ট্রানজিটের সুযোগ সৃষ্টি হতো। তবে এ প্রস্তাব বাংলাদেশকে বরং ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বিপজ্জনক অবস্থানে ফেলে দিত। অবশ্য এরপর ২০১৫ সালের জুন মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে ভারতীয় কার্গো শিপ ব্যবহারের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ।
sonadiaসোনাদিয়া বন্দর :চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যর্থতাকে আমলে নিয়ে চীন বাংলাদেশে আরেকটি গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য সম্ভাব্য পরিকল্পনা করে। তার কয়েক বছর পর ২০০৯ সালে জাপান কক্সবাজারের কাছের একটি দ্বীপ সোনাদিয়ায় জরিপ কার্য সম্পাদন করে বলে, তা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য যথোপযুক্ত জায়গা। চীন তখন সেখানে গিয়ে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১৪ সালের বেইজিং সফরে আশা করা হচ্ছিল যে, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। ধারণা করা হয় যে, সোনাদিয়া বন্দর চীনকে না দেওয়ার জন্য ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে বাংলাদেশের ওপর রাজনৈতিক চাপ রয়েছে। চীন ইতিমধ্যে শ্রীলংকা, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও মিয়ানমারে বন্দর নির্মাণ করছে। বাংলাদেশ ছিল এ ধারাবাহিকতার শেষ সূত্র, যেটা ভারতকে চতুর্দিক থেকে ঘেরাওয়ের মধ্যে ফেলে দেবে।
সোনাদিয়া নিয়ে দীর্ঘদিন চুপ থাকার পর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে সে পরিকল্পনা বাতিলের ঘোষণা দেয়। সে ঘটনায় টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ইন্দ্রাণী বাগচি লিখেছিলেন, সোনাদিয়া পরিকল্পনা বাতিল করা বাংলাদেশের স্পষ্ট কৌশলগত সিদ্ধান্ত। নিঃসন্দেহে তাতে সাহায্য করেছে ভারত, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
মাতারবাড়ী বন্দর : সোনাদিয়া বন্দর পরিকল্পনা বাতিল করার এটাও একটা কারণ যে, বাংলাদেশ সোনাদিয়া থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মাতারবাড়ীতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য জাপানের সঙ্গে চুক্তি করে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি জাইকার সঙ্গে সে চুক্তিতে বন্দর নির্মাণসহ একটি প্রাকৃতিক গ্যাসকেন্দ্র, চারটি ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, রেললাইন-সড়কপথ ও বৈদ্যুতিক অবকাঠামো নির্মাণের কথাও রয়েছে। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের খবর অনুযায়ী, এ চুক্তিতে ৪.৬ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৩.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ ৩০ বছরের জন্য ০.০১ শতাংশ হারে দেওয়ার কথা বলেছে জাইকা।
পায়রা বন্দর :আপাতদৃষ্টিতে বলা যায়, চীনের জন্য সমবেদনাস্বরূপ বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল পায়রায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রস্তাব করে। বন্দরটি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে অর্থায়নের কথা বলা হয়, যেটা একটি চাইনিজ কোম্পানি গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে অবশেষে বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ কাজ শুরু করতে যাচ্ছিল। কিন্তু তা বাতিলে ভারত, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বর আবারও শোনা যায়। শেষ পর্যন্ত পায়রা সমুদ্রবন্দরের কৌশল পাল্টিয়ে একে কয়েকটি দেশের অর্থায়নে করার কথা বলা হয়।
তবে বিশ্বের প্রধান প্রধান শক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের মতোই 'সকলের বন্ধু' নীতিই বজায় রাখতে চায়। তারপরও দেশটি আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক খেলার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে, তা বলাই যায়।

 

ট্যাগঃ , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।