Mahfuzur Rahman Manik
স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক মাদক নীতি চাই: কফি আনান
্ীহুআমার অভিজ্ঞতা বলছে, কোনো কিছু বাস্তবে হচ্ছে কি-না তার নিরপেক্ষ আলোচনার মাধ্যমে একটি ভালো গণনীতি দাঁড়াতে পারে। সাধারণ অনুমান ও জনতুষ্টির লক্ষ্যে প্রণীত নীতি অনেক সময় ভুল নির্দেশনা দেয় এবং বিপথে পরিচালিত করতে পারে।
আমাদের আলোচ্য বিষয় মাদক নীতিমালা। বৈশ্বিক মাদক নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বাস্তবতার বাইরে আবেগ ও ভাবাদর্শই প্রাধান্য পেয়েছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে গাঁজার ব্যবহার দেখা যেতে পারে। যেমন আমরা দেখছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্যও গাঁজাকে সিদ্ধ করা হয়নি। কারণ সেখানকার তরুণ প্রজন্মের মাঝে এটি গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রেই অতিরিক্ত হেরোইন সেবনের কারণে ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। কিন্তু এর আইন ও শাস্তি আগের মতোই আছে।
১৯-২১ এপ্রিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে মাদক বিষয়ে একটি বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। আমার মনে হয়, মাদক নিয়ে ভালোভাবে ভাবার, আইন-কানুন পরিবর্তনের এটা একটা ভালো সুযোগ। এ ব্যাপারে আমাদের আগেকার নীতিগুলো কতটা সঠিক? সে প্রশ্নটি আমাদের করতে হবে। বিশেষ করে বলতে গেলে, গত পঞ্চাশ বছরে নীতির কারণে মাদকের দ্বারা যে সহিংসতা, দুর্নীতি ও অস্থিতিশীলতার মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ সৃষ্টি হয়েছে, যাকে জাতিসংঘ মাদক ও অপরাধ অফিস 'অপ্রত্যাশিত ফল' বলে আখ্যায়িত করেছে, সে ব্যাপারে আমাদের পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত তা দেখা দরকার। একটু চিন্তা করুন, মাদক পাচার-সংক্রান্ত অপরাধে ২০১৩ সালে মেক্সিকোতে ১৬ হাজার হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
বৈশ্বিকভাবে 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' সফল হয়নি। অনেকে হিসাব করছেন, বছরে মাদকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় খরচ নূ্যনতম ১ বিলিয়ন ডলার তথা প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ৩০ কোটি মানুষ মাদক ব্যবহার করছে এবং এ জন্য ব্যয় করছে ৩৩০ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ মোটামুটি ২৬ লাখ কোটি টাকা। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পণ্যবাজার।
মাদকের সরবরাহ ও চাহিদার ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সামান্যই বলা চলে। যখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এক এলাকায় মাদকের সরবরাহ বা উৎপাদন বন্ধে সক্ষম হচ্ছে তখন তা অন্য অঞ্চল বা দেশে চলে যাচ্ছে; মাদক চালান অন্য পথ ধরে যাচ্ছে কিংবা মাদকসেবীরা অন্য ধরনে নেশা গ্রহণ করছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে মাদক ব্যবহারে তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। আফ্রিকা এ সমস্যার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। আমি বিশ্বাস করি, মাদক অনেক জীবন ধ্বংস করছে, এটা খুবই সত্য কথা। তবে ভুল সরকারি নীতির ফলে খেসারত আরও বেশি দিতে হচ্ছে। আমরা সবাই চাই, মাদকের ভয়াল থাবা থেকে আমাদের প্রতিটি পরিবারকে রক্ষা করতে। তবে আমাদের কোনো সন্তান যদি মাদকাসক্ত হয়ও তাকে আমরা রোগী হিসেবেই চিকিৎসা করব; অপরাধী হিসেবে নয়।
বিশ্বের অনেক জায়গায় সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করা কিংবা কারারুদ্ধ করার মাধ্যমে মাদকসেবীদের বরং চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। যখন সাহায্য করার সময় তখন কি তাদের আমরা অপরাধী বানাচ্ছি? শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অনেককে জেলে পুরছে কিন্তু মাদকসেবীদের ক্ষেত্রে যেটা দেখা যাচ্ছে, এতে বরং মাদক গ্রহণের মাত্রা আরও বাড়ছে।
সামান্য মাদক গ্রহণের ফলে কোনো তরুণ অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেলে তার দ্বারা বরং আরও অপরাধ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। জাতিসংঘ মাদক কনভেনশনে মাদকসেবীকে রক্ষার ক্ষেত্রে 'স্বাস্থ্যও মানবজাতির কল্যাণ'-এর কথা বলা হয়েছে। আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মাদক নীতিমালার ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে মূল হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
এখানে চারটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ :
প্রথমত, মাদক ব্যবহার মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর; আদালতের জন্য নয়। ফলে বিশেষত মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে চিকিৎসাসেবা শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, মাদকের ক্ষেত্রে ক্ষতি যতটা সম্ভব কমানোর চেষ্টা করা। সিরিঞ্জ আদান-প্রদানও একটা বড় পার্থক্য তৈরি করে দেয়। যেমন জার্মানিতে এ রকম পদক্ষেপের ফলে সেখানে এইচআইভি সংক্রমণের মাত্রা প্রায় ৫ শতাংশে নেমে এসেছে, যেটা কোথাও কোথাও ৪০ শতাংশের ওপরে।
তৃতীয়ত, আমাদের মাদক অবদমনের চেয়ে তা নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষার দিকে তাকানো দরকার। জেলের ভয় নয় বরং মাদকদ্রব্যের ওপর অধিক করারোপ, বেচাকেনায় বিধিনিষেধ আরোপ এবং কার্যকর মাদকবিরোধী প্রচারণায় ভালো ফল আসতে পারে।
চতুর্থত, মাদক যখন কোনো অপরাধীর হাতে পড়ে, যার স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ নেই, তার ক্ষেত্রে মাদক ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। সঠিক নিয়ম-কানুন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়। ভোক্তারা কী গ্রহণ করছে, তাতে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি কতটা ও ঝুঁকি কীভাবে কমানো যায় সে ব্যাপারে তাদের স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সরকারকে অবশ্যই বিক্রেতা ও বিক্রয় কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। কোন মাদকে কী ক্ষতি তাদেরও তা জানতে হবে। খুব ঝুঁকিপূর্ণ মাদকদ্রব্য যাতে নাগালের বাইরে থাকে, তা যেন কোনোভাবেই সহজলভ্য না হয়, নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তবে যদি কোনো চিকিৎসা-সংক্রান্ত কাজে তা ব্যবহার করা লাগে কেবল নিবন্ধিত কিছু মানুষই যাতে তা পায় সেভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। যেটা আমরা সুইজারল্যান্ডে হতে দেখেছি।
বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এবং স্বাস্থ্য ও মানবাধিকারের যথাযথ সুরক্ষা করেই মাদক নীতি গ্রহণ করতে হবে। তার মানে এটা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কিছু মানুষ অধিক মাত্রায় মাদক গ্রহণের ফলে মৃত্যুর কোলে ঢলে না পড়ে এবং সামান্য মাদক গ্রহণ করেই যেন জেলে না যায়, তাতে বরং মাদক সমস্যা আরও বাড়বে। একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক যথার্থ মাদক নীতি গ্রহণের সময় এখনই। জার্মানির মতো অন্যান্য দেশ একটি ভালো নীতি গ্রহণ করতে পারে। মাদকের প্রচলিত ভুল নীতি পর্যালোচনা করে তাকে বাস্তবসম্মতভাবে পরিবর্তন করতে হবে। জাতিসংঘের মাধ্যমেই সেটা শুরু হতে পারে।
ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।