Mahfuzur Rahman Manik
নদীর বাঁকে জীবনের সুর
মার্চ 20, 2016
উপন্যাস: বলেশ্বরী পেরিয়ে
উপন্যাস: বলেশ্বরী পেরিয়ে

বলেশ্বরী বা বলেশ্বর (Baleswar) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পিরোজপুর, বাগেরহাট ও বরগুনা জেলার একটি নদী। একে কেন্দ্র করে উপন্যাসটি লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা মিহির সেনগুপ্ত। এত নিখুঁত বর্ণনা যে, এটি পড়লে কেউ হয়তো ভাবতেই পারবেন না_ লেখক বাংলাদেশের নন। আসলে বাংলাদেশে বাস না করলেও লেখকের জন্ম কিন্তু বলেশ্বরীর কাছেই। বরিশালে তার জন্ম দেশবিভাগের অব্যবহিত পরই, ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ১৯৬৩ সালে পাড়ি জমান পশ্চিমবঙ্গে। উপন্যাসটি হয়তো তারই জীবন কাহিনী কিংবা তার দেখা কারও। উপন্যাসে যদিও মূল চরিত্র সুপর্ণ ও শ্যামশ্রী। হয়তো পশ্চিমবঙ্গ থেকেই তারা এসেছেন। 'বলেশ্বরী পেরিয়ে' কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য শ্যামশ্রী বাপের বাড়ি যাবে। বাংলাদেশে বছরে এক-দুইবার আসে। বলেশ্বরী নদীর ঘাট থেকেই কাহিনী শুরু। ঘাটে এসেই সুপর্ণ ও শ্যামশ্রী তাদের পরিচিত মুচকুন্দকে পেয়ে যায়। মুচকুন্দকে নিজেদের গাড়িতে উঠিয়ে নেয়। বলেশ্বরী পেরিয়ে গাড়ি চলছে গন্তব্যে, আর চলছে গালগল্প। এভাবে অনেকটা পারস্পরিক কথাবার্তা, আলোচনার ঢঙেই শেষ হয় উপন্যাসটি। গাড়িতে মুচকুন্দ ও তারপর বাড়িতে পেঁৗছে পরিচিত নানা মানুষের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথোপকথন। যেখানে উঠে এসেছে এখানকার সমাজ জীবন, গ্রামীণ জীবন, সাম্প্রতিক পরিবর্তন, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, অতীত জীবনের স্মৃতিচারণ ইত্যাদি। বোদ্ধাদের কাছে হয়তো উপন্যাসটি দুই বাংলার মানুষের সম্পর্ক, সম্পর্কের সূত্র ও ঐতিহাসিক বিষয় হিসেবেও হাজির হবে। 'বলেশ্বরী পেরিয়ে' এটি পেঁৗছে গেছে মানুষের জীবনে। সুপর্ণ-শ্যামশ্রীরা কাছে পায় প্রিয় মানুষদের। স্বজন ও পরিচিত মানুষের জীবন সংগ্রাম তারা প্রত্যক্ষ করে। উভয়েরই ভালো বয়স হয়েছে। পরিচিত অনেকেই চলে গেছে না-ফেরার দেশে। অনেকেই শয্যাশায়ী; যাওয়ার পথে। সোবহান কাকা, সুধাময়ী, রজব, লক্ষ্মী, নেয়ামত, রণজিত, ইউসুফ নানা চরিত্রের মানুষের জীবন কাহিনীতে তারা মুগ্ধ। আবেগ-উচ্ছ্বাস-ভালোবাসায় এখানে যেন দুই বাংলা একাকার হয়ে গেছে।
উপন্যাস লেখার ধরণ-ধারণ, বর্ণনা, শব্দ চয়ন ব্যতিক্রম। লেখকের বয়স যে ঢের হয়েছে- এটা তারই প্রমাণ। এটা হয়তো তার একাধারে ব্যক্তিগত ও লেখক দুই দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার ফল। তিনি চরিত্রের প্রয়োজনে তার গ্রাম্য ভাষাও এনেছেন। যথাসম্ভব ছোট ছোট বাক্যে লিখেছেন। লেখায় নিজস্ব ভঙ্গি লক্ষণীয়। মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দও ব্যবহার করেছেন। কিছু কিছু শব্দ-বাক্য এখানকার সাধারণ পাঠক সহজে বুঝতে পারবেন কি-না সন্দেহ। তবে কাহিনী বর্ণনায় কোনো খুঁত নেই। ঘটনা পরম্পরায় একটার পর একটা হাজির। সুপর্ণ-শ্যামশ্রীরা কখনও কল্পনায় কথা বলেছে, ফিরে গেছে তাদের সে দিনগুলোতে। সেগুলো হয়তো লেখকেরই কল্পনা। তার জন্মস্থানের সে সময়কার স্মৃতি উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি রোমন্থন করেছেন।
যে বলেশ্বরী নদী দিয়ে উপন্যাসটি শুরু, ঘটনার পরম্পরায় বলেশ্বরী পেরিয়ে গেলেও শেষ করেছেন আবার সেই নদীকে কেন্দ্র করেই। নানা নদীর কথা এসেছে উপন্যাসটিতে। আজকের দিনে আমাদের নদীর দুর্দশার চিত্র ও তার কারণও এসেছে। শেষদিকে এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, 'এসব অঞ্চলের অজস্র নদী খাল, ঝোরা সবই একদিন সুগন্ধা থেকে জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু আমাদের নিরন্তর অনাচারের এবং অতিরিক্ত ফসল লাভের লোভে তারা সব শুকিয়ে গেছে।' এ কথোপকথন ধরেই একেবারে শেষ পর্যায়ে আমরা চলে আসি। সুপর্ণ-শ্যামশ্রীদের যাওয়ার সময় হয়ে যায়। আবার এ দেশে আসার কথা তারা বলে। তাদের এখানকার দিনগুলো হয়তো বড় মধুর ছিল। যাওয়ার বেলায় হয়তো তারা আবারও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। হয়তো কিছুটা আবেগিও। তারপরও যে তাদের যেতে হবে। আসলে এ যে জীবন। জীবনের এক কঠিন বাস্তবতা। এটি হয়তো নদীর মতোই। এ-কূল ভাঙা ও-কূল গড়া যে জীবন ও নদী উভয়েরই খেলা।

ট্যাগঃ , , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।