স্মার্ট ভর্তি পদ্ধতির কথা শুনে সবার ভালো লাগারই কথা। বাস্তবে এর নামে এবারের এইচএসসি ও সমমানের ভর্তি নিয়ে যা হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভুলেরও একটা সীমা থাকে। কারিগরি জটিলতা কাটিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের চার দিন পর (২৮ জুন) প্রকাশিত প্রথম মেধা তালিকায় দেখা গেল_ মেয়েদের কলেজে ছেলেদের নাম, মানবিকের শিক্ষার্থী বিজ্ঞানে, কম জিপিএ পেয়ে ভালো কলেজে ভর্তি আর জিপিএ ৫ পেয়েও তালিকায় নেই। এ রকম ভুলের ছড়াছড়ি। এমনকি ব্যবসার শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয়েছে বিজ্ঞান কলেজে। পছন্দের তালিকায় ছিল না, তার পরও অন্য জেলার এমন কলেজের নাম এসেছে, যেটা শিক্ষার্থী কখনোই শোনেনি। ভুল আর তালগোল পাকানো প্রথম তালিকায় কলেজই পায়নি ৫০ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মতে, ভর্তি কার্যক্রম শেষ করে যেখানে ১ জুলাই থেকে একাদশ শ্রেণীর নতুন ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল, সেখানে তখনও বঞ্চিত লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। ভর্তি নিয়ে গোটা সপ্তাহ ধরে চলা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে ৫ জুলাই সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিব। মন্ত্রী এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। একে 'উন্নয়নের বেদনা' বলে আখ্যায়িত করেন। যদিও শিক্ষা সচিব বলেছেন, 'টি২০-তে ছক্কা মারার চেষ্টা করেছি।' কিন্তু সে ছয় বাউন্ডারি পেরোয়নি। শিক্ষামন্ত্রী চার ধাপে ভর্তির কথা বলেছেন। ৬ জুলাই দ্বিতীয় মেধা তালিকা প্রকাশের পরও দেখা গেল, অনেক শিক্ষার্থী কোনো কলেজ পায়নি। একই সঙ্গে অন্যান্য ভুলের কারণে মোট দুই লক্ষাধিক শিক্ষার্থী এখনও কোনো কলেজে ভর্তি হয়নি (ডেইলি স্টার, ৯ জুলাই)। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীও রয়েছে। ইতিমধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় সারির কলেজগুলোর আসন প্রায় শেষ। অন্যদিকে ভর্তি করতে শিক্ষার্থী পাচ্ছে না সহস্রাধিক কলেজ (প্রথম আলো, ৮ জুলাই)। এ অবস্থায় আবারও শিক্ষার্র্থীদের আবেদন করতে বলা হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য বলে রেখেছেন, কোনো ফি ছাড়াই ২১ জুলাই পর্যন্ত আবেদন করে ভর্তি হওয়া যাবে। শিক্ষার্থীরা এখন কোন কলেজে ভর্তি হবে? প্রথমবার ১১ লাখ ৫৬ হাজার শিক্ষার্থী আবেদন করেছিল। এর মধ্যে ভর্তি হতে পেরেছে ৯ লাখ ৩০ হাজার। তার মানে দুই লাখ ২৬ হাজার ভর্তি হতে পারেনি। আর দ্বিতীয় মেধা তালিকায় ১৭ হাজার শিক্ষার্থীকে সুযোগ দেওয়া হয়। এখনও দুই লাখের অধিক ভর্তি হয়নি। যার মধ্যে এক-চতুর্থাংশই জিপিএ ৫ প্রাপ্ত (সমকাল, ৭ জুলাই)। এটা বলাই যায়, ভুলের শিকার হওয়া এই শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত কলেজে ভর্তি হতে পারছে না। যেহেতু ভালো কলেজগুলোতে আসন প্রায় শেষ; এমনকি আমরা দেখেছি, দ্বিতীয় মেধা তালিকায় স্থান পাওয়ার পরও রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি নিচ্ছে না। তার জন্য কলেজের সামনে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর অবস্থানের চিত্রও দেখা গেছে। সব মিলিয়ে এবারের একাদশ শ্রেণীর ভর্তির বিশৃঙ্খল চিত্র আমরা দেখছি। 'স্মার্ট' পদ্ধতির শিকার হয়ে যে শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত কলেজে ভর্তি হতে পারছে না, তার স্বপ্নভঙ্গের দায় কে নেবে? এটা হয়তো ঠিক, ব্যানবেইসের হিসাবে, সারাদেশে সব মিলিয়ে কলেজের সংখ্যা তিন হাজার ৭৫৭। এর মধ্যে 'কাঙ্ক্ষিত' কলেজের সংখ্যা দুইশ'ও নয় এবং এগুলোর আসন ৫০ হাজারের বেশি নয়। অথচ এবারের জিপিএ ৫-এর সংখ্যা লক্ষাধিক। ফলে এমনিতেই হয়তো অনেকে 'কাঙ্ক্ষিত' কলেজে ভর্তি হতে পারত না। কিন্তু তার পর একজনও যদি এ স্মার্ট পদ্ধতির কারণে বঞ্চিত হয় তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এ সময়ে শিক্ষার্থীদের একটা উদ্যম থাকে, সামান্য কারণেও সেটা ভাটা পড়তে পারে। এমনকি এবারের ভর্তি নৈরাজ্যের কারণে অনেক শিক্ষার্থীর কান্নার চিত্রও সংবাদমাধ্যমে এসেছে। ভর্তিতে এ বিশৃঙ্খলা কেন হলো? সমকালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রাথমিকভাবে কেবল তিনশ'র বেশি আসন আছে, কেবল এমন কলেজে অনলাইনে ভর্তি নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে শিক্ষা সচিবের সিদ্ধান্তে দেশের সব প্রতিষ্ঠানের জন্য তা কার্যকর হয়। অথচ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কারিগরি প্রস্তুতি তাদের ছিল না। প্রথম সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনশ'র বেশি আসনবিশিষ্ট কলেজের জন্য তিন লাখ শিক্ষার্থী আবেদন করত। কারিগরি প্রস্তুতিও কেবল তিন লাখ শিক্ষার্থীর জন্যই ছিল। ফলে ১১ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী ব্যবস্থাপনায় তারা ব্যর্থ হয়। ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি ডাটা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সার্ভার জটিলতায় পড়ে। তা ছাড়া ইন্টারনেটের মাধ্যমে আবেদন করার কারণে অনেক শিক্ষার্থী ভুল করে থাকতে পারে। বিশেষ করে কলেজ নির্ধারণসহ অন্য বিষয়গুলো যথাযথভাবে হয়তো দিতে পারেননি। যেহেতু অনেকেরই ব্যক্তিগত ব্যবস্থা নেই, তাই সারাদেশের শিক্ষার্থীরা নানাভাবে ওয়েবসাইটে গিয়ে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। কেউ হয়তো দোকানে গিয়ে করেছে বা অন্যজনকে দিয়ে করিয়েছে। ফলে এখানে শিক্ষার্থীর তরফ থেকেও ত্রুটি থাকা অস্বাভাবিক নয়। একই সঙ্গে যেহেতু প্রশাসনের সামর্থ্য ও প্রস্তুতি সে রকম ছিল না, সে জন্য ওয়েবসাইট ডাউন হওয়াসহ নানা কারিগরি জটিলতায়ও শিক্ষার্থীদের পড়তে হয়েছে।
এটা ঠিক, 'স্মার্ট অ্যাডমিশন সিস্টেম' কেবল নামেই নয়, হয়তো পদ্ধতি হিসেবেই ভালো ছিল। কিন্তু প্রস্তুতি ও সামর্থ্য ছাড়া তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যা হওয়ার কথা ছিল তা-ই হয়েছে। শিক্ষা সচিব হয়তো ছক্কা মারতে চেয়েছেন কিন্তু ফুটওয়ার্ক না করে ছক্কা মারলে আউট হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এটা প্রকারান্তরে শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়েই খেলা, যা কখনোই কাম্য নয়। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তি এবং যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যে কাঙ্ক্ষিত কলেজে ভর্তি হতে পারছে না, তার দায় প্রশাসন এড়াতে পারে না।
এর আগে এসএমএসের মাধ্যমে কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতো। সেখানে বিড়ম্বনা অনেক কম ছিল। সম্পূর্ণ অনলাইন পদ্ধতি গ্রহণের ক্ষেত্রে যেমন নিজেদের সামর্থ্য দেখার বিষয় রয়েছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের দিকও বিবেচনায় রাখা দরকার। গ্রামের বিদ্যালয় থেকে এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় পাস করা অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষেই অনলাইনের এ কার্যক্রম সম্পন্ন করা কঠিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি অনলাইনে হচ্ছে এটা ঠিক। তবে কলেজ পর্যায়ের ভর্তিও অনলাইনে হতে পারে, তার জন্য আমাদের আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। সময়ের আগে কোনো কিছু করতে গেলে তার ফল যে ভালো হয় না, এবারের স্মার্ট সিস্টেমই তার প্রমাণ।
- সমকালে প্রকাশিত, ১০ জুলাই ২০১৫
- ই-সমকাল থেকে দেখুন
- ছবি: অনলাইন