ছিটমহলের অন্ধকার যখন কাটতে শুরু করেছে তখন আলোই সেখানকার গন্তব্য। দুই দেশের তরফ থেকে আইনগত বাধা দূর হওয়ার কথা জেনে শুরুতেই ছিটমহলবাসী সে আলোর সন্ধান করেছেন। ৭ মে সর্বশেষ ভারতের লোকসভায় এ সংক্রান্ত বিল পাসের পর থেকেই তাই সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে আমরা জানতে পারছি, সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য 'সাইনবোর্ড তোলার হিড়িক'। যদিও সেগুলো প্রস্তাবিত এবং প্রাথমিক পর্যায়ে কেবলই সাইনবোর্ড, তারপরও এর মাধ্যমে কেবল একটা বার্তাই ছিটমহলবাসী দিচ্ছেন যে, তারা দ্রুতই শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে চান। আর সর্বশেষ মঙ্গলবার (২৩ জুন) প্রকাশিত 'খুলেছে শিক্ষার বন্ধ দরজা' শিরোনামে সমকালের প্রতিবেদনটি যে তারই ধারাবাহিকতা। যেটি বলছে, ছিটমহলগুলোতে প্রাথমিকভাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন শিক্ষার কাজ হাতে নিয়েছে। তারা মসজিদভিত্তিক শিশু শিক্ষা ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পের আওতায় প্রথম রমজান থেকেই ১০০টি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র চালু করেছে। এটা অবশ্যই আশাজাগানিয়া খবর। যদিও তারা কেবল প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করছে এবং সেটা প্রয়োজনের তুলনায় হয়তো নগণ্য।
তারপরও এটি যে ছিটমহলবাসীর প্রত্যাশার প্রাথমিক ধাপ তা বলতেই হবে। যেখানে এতদিন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে থাকা ১১১টি ছিটমহলের ৩৭ হাজারেরও অধিক মানুষের কেবল শিক্ষার অধিকারই নয়, কোনো অধিকারই ছিল না। যেখানে সমকালের সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনসহ নানা মাধ্যমে আমরা জেনেছি, ছিটমহলবাসীদের বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়ার জন্য 'ভুয়া' ঠিকানা ব্যবহার করতে হতো। যেখানে এত বছর ধরে উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই ছিল না, সেখানে এই উদ্যোগ নিশ্চয়ই ছিটমহলবাসীর কাছে স্বপ্নের মতো।
আর প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বলার বিষয় হলো, রাতারাতি অনেক প্রতিষ্ঠান গড়া সম্ভব নাও হতে পারে। তারপরও যত দ্রুত সম্ভব এলাকা, প্রয়োজন ও আবশ্যকতা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যেতে পারে। একই সঙ্গে এতদিন যারা অন্য ঠিকানায় বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে আসছে, তাদেরকে ছিটমহলের ঠিকানায় পড়ার অনুমতি প্রদান করা দরকার। ছিটমহলের যে কোনো এলাকার অধিবাসী যেন আমাদের যে কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়তে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক ও শিক্ষার্থী যেন কোনো ধরনের বিড়ম্বনা ও হয়রানির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করতে হবে।
এটা ভালো খবর যে, ছিটমহলের অনেকেই বাংলাদেশের ঠিকানা ব্যবহার করে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে সর্বোচ্চ ডিগ্রিও নিয়েছেন। অনেকে হয়তো চাকরিও করছেন। কিন্তু একই সঙ্গে খারাপ বিষয় হলো, অনেকে সরকারি চাকরি করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। পুলিশ ভেরিফিকেশনে বাদ পড়েছেন। অনেকে আবার চাকরি পাওয়ার পরও ছিটমহলের অধিবাসী প্রকাশ হওয়ার পর চাকরি হারিয়েছেন। এখন নিশ্চয়ই এ অবস্থার অবসান ঘটবে। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, এতসব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে হয়তো অল্পসংখ্যকই উচ্চশিক্ষা অর্জনে সামর্থ্য হয়েছেন। এমনকি যেহেতু ছিটমহলের অধিবাসীদের পড়াশোনা করতে গেলেই বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে, সেহেতু অনেকেই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত হয়েছেন। আবার কষ্ট করে পড়াশোনার পর চাকরি ক্ষেত্রে বাধা থাকার কারণে হয়তো অনেকে পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়েছেন।
এসব কারণে ছিটমহলে সাক্ষরতার হার কম হওয়াই স্বাভাবিক। যদিও এ নিয়ে কোনো জরিপ নেই। তাই প্রকৃতপক্ষে সেখানে কত শতাংশ সাক্ষর রয়েছে তা বের করাও সরকারের প্রাথমিক কাজ হওয়া উচিত। এই জরিপ কাজ অবশ্য প্রশাসন চাইলে নাগরিকত্ব নির্ধারণের সময়ই করতে পারে। জরিপকারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য নেওয়ার সময় শিক্ষাসহ সব তথ্য একসঙ্গে নিলেই বরং পরবর্তী যে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে। একই সঙ্গে ছিটমহলের নিরক্ষর জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে বয়স্কদের সাক্ষর করার বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে। কারণ দেশের সার্বিক সাক্ষরতার হার নির্ধারণে তাদের সংখ্যাও গুরুত্বপূর্ণ।
আসলে এখন থেকে তাদের ছিটমহলবাসী না বলে বাংলাদেশিই বলা প্রয়োজন। 'ছিটমহল' শব্দটা নিজেই যে একটা বড় বাধা। যতদিন আমরা তাদের নিজেদের অংশ মনে না করব, ততদিন তারা কোনো না কোনো ক্ষেত্রে বঞ্চিত থেকেই যাবে। অথচ সীমান্ত চুক্তি পাস হওয়ার পর তাদের উচ্ছ্বাস আমরা দেখেছি। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে তাদের আনন্দ মিছিল সবাই দেখেছেন। এখন তাদের স্বপ্ন পূরণে আমাদের কাজ করতে হবে। তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা সরকারেরই দায়িত্ব। বিশেষ করে সেখানকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নে শিক্ষার বিকল্প নেই। ছিটমহলের কোনো শিশুই যাতে বিদ্যালয়ের বাইরে না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষায় আমাদের অর্জন যেখানে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। যেখানে আমাদের প্রায় সব শিশুই বিদ্যালয়ে যায় সেখানে ছিটমহলেও একই চিত্র প্রত্যাশিত। সেখানে যাতে দ্রুত প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং আমাদের মতোই যেন শিশুরা বছরের প্রথম দিনে নতুন বই পায়।
ছিটমহলবাসীর প্রত্যাশা হয়তো উচ্চাভিলাষী হবে না। তারা হয়তো তাদের সন্তানের 'দুধে-ভাতে' অবস্থা কল্পনা করে না। অন্তত নাগরিক স্বীকৃতির আইনি বাধা উঠে যাওয়ার খবরে তাদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার ধরণ তা-ই বলছে। দীর্ঘদিনের বঞ্চিত মানুষগুলো নিশ্চয়ই অল্পতেই সন্তুষ্ট হবে। তাই বঁাঁচার জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা না হলেই নয় তা যেন সরকার নিশ্চিত করে। আর হ্যাঁ, তাদের জন্য শিক্ষাটা যেন অগ্রাধিকারে থাকে। শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে বাকি অনেক প্রয়োজন তারা নিজেরাই মেটাতে পারবে।