Mahfuzur Rahman Manik
জীবনের ঠিকানায় 'মেঘবালকের চিঠি'

Megh-baloker-chithiমানুষ কতভাবেই না গল্প বলে! প্রতিটি মানুষের গল্প আলাদা। জীবনের বিচিত্র গল্পগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা মেলে না। তারপরও মোটা দাগে কিছু বিষয়ে আমরা সাযুজ্য খুঁজে পাই। যেমন, ভালো-মন্দ, আনন্দ-বেদনা, সাফল্য-ব্যর্থতা, ভালোবাসা-অনাদর ইত্যাদি। সেদিক থেকে সোহেল নওরোজের 'মেঘবালকের চিঠি'র পনেরোটি গল্প কারও না কারও জীবনের সঙ্গে মিলে যাওয়াই স্বাভাবিক। বুকপকেটের মুখগুলো, মেঘবতী, ঘ্রাণ, চার মাত্রার ভালোবাসা কিংবা দৌড় গল্প একেকটা জীবনের একেক অধ্যায়ের কথা। ঘ্রাণ গল্পটা পড়ে প্রত্যেকে হয়তো ফিরে যাবেন তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। কিংবা এখনও যারা হলে থাকেন, ঘুমানোর সময় মায়ের কষ্টে সেলাই করা কাঁথার ঘ্রাণ নেন, তাদের কাছে গল্পটি নিজেরই মনে হতে পারে। বইয়ের প্রতিটি গল্পই অন্যরকম। কোনোটা ভালোবাসার, কোনোটা সামাজিক, কোনোটা রোমান্টিক, কোনোটা কষ্টের আবার কোনোটা আনন্দের।

'চন্দ্রস্নানে চলো' নামেই রোমান্টিকতার গন্ধ। গল্পটা পড়ে পাঠক সেটা টের পাবেন। কিন্তু গল্পটা লেখক যেদিক থেকে টেনে এনেছেন সেখানে লেখকের মুনশিয়ানার তারিফ না করে পারা যায় না। বাস্তবতা বোধ হয় এ রকমই। জীবনের কষ্টগুলো জমতে জমতে যখন পাথর হয়ে যায়, দীর্ঘ দুঃখ যখন সহ্যের সীমানা অতিক্রম করে, যখন আর উপায় থাকে না তখন মানুষ হিংস্র হয়ে ওঠে। গল্পের আবীরের তা-ই হয়েছে। দীর্ঘ পদোন্নতিবঞ্চিত আবীর যখন তার বসকে মেরে ফেলার জন্য পিস্তল নিয়ে অফিসে আসে সেদিনই কাকতালীয়ভাবে তার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়। এর পরই তিনি স্ত্রীর সঙ্গে যান চন্দ্রস্নানে।
প্রতিটি গল্পই এ রকম মোড় ঘোরানো। তার চেয়ে বড় কথা বোধ হয় লেখার ঢঙ। অত্যন্ত সহজ সুন্দর ও প্রাঞ্জল ভাষায় লেখক ঠিক গল্পের মতোই লিখেছেন। নানা উপমা গল্পগুলোকে অসাধারণ করে তুলেছে। 'যেন মহাকাশ থেকে আলোর বেগে মাটিতে পড়ি', 'আকাশের পুঞ্জীভূত মেঘ গলে টিপটিপ বৃষ্টি' কিংবা 'চোখের জলবাষ্প আর হৃদয়ের ক্ষরণ' যথার্থভাবেই ব্যবহার করেছেন লেখক। একই সঙ্গে গল্পের মাঝে মাঝে ডায়েরিতে লিখে রাখার মতো কিছু আপ্তবাক্যও পাঠক পাবেন। 'বুকপকেটের মুখগুলো' গল্পে 'কিছু তুচ্ছ ঘটনা অনেক সময় বড় ঘটনার চেয়ে বেশি পীড়াদায়ক হয়' তারই একটি।
প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ সময়ে লেখক গল্পের খাতিরে ফেসবুকের কথা এনেছেন। এসেছে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, কম্পিউটারের কথাও। তারপরও এটি 'মেঘবালকের চিঠি'। ডিজিটাল এই সময়ে যখন চিঠির কদর নেই বললেই চলে; যখন মুহূর্তেই মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব; যখন ইন্টারনেট, ই-মেইলে দুনিয়ার একপাশ থেকে অন্যপাশে সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে; ঠিক তখন লেখক হাজির হয়েছেন মেঘবালকের চিঠি নিয়ে। এ চিঠি হয়তো সে চিঠি নয়। যেখানে ডাকপিয়ন আসবে, নতুন খবর দেবে। তবে প্রতিনিয়তই তো নানা খবর মানুষের আসে। সেসব একেকটা তো চিঠিই। অবশ্য লেখক বলছেন, এখন ডাকপিয়ন না এলেও মেঘপিয়ন আসে। আবার আমরাও তো 'আকাশের ঠিকানায় চিঠি' লিখি। জীবনের প্রতিটি ক্ষণের অনুভূতি প্রথমেই আকাশের কাছে ব্যক্ত করি। বেদনাহত মানুষ আকাশের দিকে তাকায়। আকাশের বিশালতায় মানুষের কষ্টগুলো নিমিষেই হারিয়ে যায়। তখন হয়তো আকাশের মেঘই কষ্টগুলো লুকিয়ে রাখে।
সোহেল নওরোজের বইয়ের শেষ গল্পের নামও 'মেঘবালকের চিঠি'। যেটা লেখা হয়েছে রোদবালিকার উদ্দেশে। ভালোবাসার সে অসাধারণ চিঠি পড়ার জন্যও হয়তো পাঠক বইটি খুঁজবেন।
ট্যাগঃ , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।