Mahfuzur Rahman Manik
গণমানুষের শিল্পী
ডিসেম্বর 30, 2014
Abbas-U
শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমদ (অক্টোবর ২৭, ১৯০১ - ডিসেম্বর ৩০, ১৯৫৯)

গান মানুষকে বিনোদিত করে। অনেকের একাকী সময়ে সঙ্গী গান। কাজের মধ্যে গান না শুনলে কারও আবার কাজটা নাকি ঠিকমতো হয় না। এটি মানুষকে আলোড়িত করে। হাজারো শিল্পী, হাজারো গানের মাঝে প্রত্যেকে তার প্রিয় শিল্পী খুঁজে নেন। তার মাঝেও কিছু শিল্পী থাকেন যারা সবার জন্য হয়ে ওঠেন। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন তাদেরই একজন। প্রজন্মের পর প্রজন্মান্তরে তার বসত এখনও সাধারণ মানুষের অন্তরে।
'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ' গানটি ঈদের আনন্দ আরেকটু বাড়ায় কি-না জানা নেই। তবে রোজার ঈদ এলে গানটি যে অনেকেরই নিত্যসঙ্গী সে কথা বলাই বাহুল্য। বাঙালি মুসলমানের কাছে আকাঙ্ক্ষিত ঈদ যে আনন্দ নিয়ে আসে তা নিয়ে হাজারো গান থাকলেও এই একটি গান ছাড়া যেন ঈদ পূর্ণ হয় না। গানটি সে শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের অনুরোধেই ১৯৩১ সালে কবি নজরুল রচনা ও সুরারোপ করেন। যে সময়ে মুসলিম সমাজে গান গাওয়া নিষিদ্ধ ছিল সে সময়ে শিল্পী আব্বাসউদ্দীন গানটিতে কণ্ঠ দিয়ে মুসলিম সমাজেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তার গলায় গানটি রেকর্ড করার দুই মাস পরে ঈদের ঠিক আগে আগে গ্রামোফোন কোম্পানি এর রেকর্ড প্রকাশ করে। আব্বাসউদ্দীন ছিলেন প্রথম মুসলমান গায়ক, যিনি আসল নাম ব্যবহার করে এইচএমভিতে গানের রেকর্ড বের করেন। তার রেকর্ডগুলো যেমন জনপ্রিয় ছিল, তেমনি বাণিজ্যিকভাবেও ছিল সফল।
রংপুর ও কোচবিহার অঞ্চলের ভাওয়াইয়া-ক্ষীরোল-চটকা গেয়ে তিনি প্রথম সুনাম অর্জন করেন। আধুনিক গান, স্বদেশী গান, ইসলামী গান, পল্লীগীতি, উর্দু গান সবই তিনি গেয়েছেন। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, বিচ্ছেদী, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালাগান ইত্যাদি পল্লীগানের নানা শাখায় তার অবদান অসাধারণ। সেসব গানের রেকর্ড মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 'ওকি গাড়িয়াল ভাই', 'আমার হাড় কালা করলাম রে', 'আমায় ভাসাইলি রে', 'নদীর কূল নাই, কিনার নাই', 'আল্লাহ মেঘ দে পানি দে' ইত্যাদি গান সাধারণ মানুষের কণ্ঠ হিসেবেই তার গলায় বেজেছে। গানের মাধ্যমে তিনি কেবল সে সময়ের সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করেননি, আজও তা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। অবসরে-বিনোদনে-আনমনে এখনও মানুষ আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে সুর তোলে। অথচ এই কিংবদন্তিতুল্য শিল্পীর সে অর্থে গানের তেমন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ছিল না। যাত্রা, থিয়েটার ও স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান শুনে তিনি গানের প্রতি আকৃষ্ট হন। নিজ চেষ্টায় তিনি গান করেন। কিছু সময়ের জন্য তিনি ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁর কাছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিখেছিলেন। তার প্রচেষ্টাই তাকে সঙ্গীতে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। তার দরদভরা সুরেলা কণ্ঠ আজও অদ্বিতীয়। গ্রামোফোন কোম্পানিতে তার বহু গানের রেকর্ডের মধ্যে ৮৪টি ইসলামী গান, পল্লীগীতি ৫৮টি, ভাওয়াইয়া ৩৭টি, কাব্যগীতি ৩১টি। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আধুনিক গানসহ অনেকে তার রেকর্ডকৃত গানের সংখ্যা বলেছেন সাতশ'।
পেশায় সরকারি চাকুরে শিল্পী আব্বাসউদ্দীন চারটি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। লিখেছেন আত্মচরিতমূলক গ্রন্থ 'আমার শিল্পীজীবনের কথা'। সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য প্রাইড অব পারফরম্যান্সসহ (১৯৬০), শিল্পকলা একাডেমি (১৯৭৯) ও স্বাধীনতা দিবস (১৯৮১) পুরস্কার তিনি পেয়েছেন মরণোত্তর। ১৯০১ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত ৫৮ বছরের জীবনে তিনি সঙ্গীত জগতে যে অবদান রেখে গেছেন, তা জাতি যুগ যুগ ধরে স্মরণ রাখবে।
আজ মৃত্যুবার্ষিকীতে এই সঙ্গীত সম্রাটের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।