১৯৫৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দুনিয়া থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নেন ভারতবর্ষের অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামী, ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম এর লেখক মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। এটি কেবল অসাধারণ মানবিকতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তিত্বের মৃত্যুই ছিল না। বরং এর মাধ্যমে একটি স্বপ্নেরও মৃত্যু ঘটে। অবিভক্ত ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানরা শান্তিতে বসবাস করতে পারবে, এ ধরনের একটি স্বপ্ন কয়েক দশক ধরেই দেদীপ্যমান ছিল। শত শত বছর আগে মুসলমানরা ভারতে তাদের আবাসস্থল গড়েছিল এবং এ দেশকে তাদের নিজেদের দেশ মনে করত। মাওলানা আজাদের মতে, ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। যদিও ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির মাধ্যমে মাওলানা আজাদের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে। এরপরও আজাদ আরও দশ বছর বেঁচে ছিলেন। সে সময় তিনি নতুন ভারতের ক্ষত নিরাময় এবং দেশটিকে নতুনভাবে সাজানোর জন্য চেষ্টা করেছিলেন।
মাওলানা আজাদের এক জীবনে অনেক স্বপ্ন ছিল। তার কিছু কিছু সবাই জানে আর কিছু স্বপ্ন এখনও রহস্যজনকভাবে অজানা। এসবের কমই বলা চলে জানা গেছে কিংবা লিখিত হয়ে মানুষের সামনে এসেছে। তার জীবনের প্রথম দিকের এক দশকেই তার উত্তরাধিকার সূত্রে লালিত বিশ্বাসে মোহমুক্তি ঘটে।
তারও আগে ছোট থাকতেই তিনি স্বাধীনচেতা ছিলেন। তখনই তিনি তার বাবার বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। তারা বাবা মৌলভী খাইরুদ্দিন স্যার সৈয়দ আহমেদের আধুনিকতাকে ঘৃণা করতেন এবং সঙ্গীতে বাবার অনুমতি না থাকলেও তা উপেক্ষা করে মাওলানা আজাদ সেতার শেখার সিদ্ধান্ত নেন। উত্তরাধিকার সূত্রে চলে আসা এ সব চিন্তা-চেতনার বিরুদ্ধে তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেন; এমনকি আরও অগ্রসর হয়ে একটা সময়ে বস্তুবাদ ও যুক্তিবাদে বিশ্বাসী হয়ে যান।
তবে তার জীবনে এ অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী ছিল না; দ্রুতই তিনি ইসলামে ফিরে আসেন। তার ইসলাম ছিল গুণগতভাবে ভিন্ন; ইসলামচর্চা অন্য সবার তুলনায় ছিল স্বতন্ত্র। মাওলানা আজাদ নিজে থেকেই সচেতন ছিলেন, যদিও কম মানুষই তার সঙ্গে ছিল; তখন তিনি বলেছিলেন, 'ধর্মীয় দিক থেকে, সাহিত্যে, রাজনীতিতে সর্বোপরি দর্শনের পথে_ সর্বত্রই আমি একা হয়ে পড়ছিলাম। আমার যাত্রাপথের সে সময়টা প্রতিকূল ছিল।' মাওলানা আজাদ তার জীবনের সর্বক্ষেত্রে কোরআনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ চেতনার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন, কারণ কোরআন সব বিশ্বাসী মুসলমানের কাছেই পাওয়া সহজ ছিল। তিনি ইসলাম সম্পর্কে মৌলভীদের মত প্রত্যাখ্যান করে ইসলামের ব্যাখ্যার জন্য স্বাধীন চিন্তা বা ইজতিহাদকে গ্রহণ করেন। তিনি কোরআন পড়ার ব্যাপারে কোরআনের নিজস্ব ব্যাখ্যার বাইরে ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা স্বীকার করেননি। এটি ছিল তখনকার প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে ইসলামের বিষয়ে প্রত্যেকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করছিলেন।
মাওলানা আজাদ উনিশ শতাব্দীর শেষ দিকে ভারতের নিজস্ব শিক্ষার প্রেক্ষাপটে ইসলামিক শিক্ষা, বিশেষত মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা এবং তার পাঠ্যসূচি সম্পর্কে কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, 'এটি ছিল শিক্ষার একটি সেকেলে পদ্ধতি, যেটি শিক্ষার সবদিক থেকে অনুর্বর। এর শিক্ষণ পদ্ধতি ছিল ত্রুটিপূর্ণ, শেখার বিষয়গুলো ছিল অর্থহীন, বই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ছিল জ্ঞানের অভাব আর পঠন ও অঙ্কন পদ্ধতি ছিল ত্রুটিপূর্ণ।' তিনি মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে শতবছর আগে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন, এ পর্যায়ে এসেও আমরা মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপারে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। এমনকি তিনি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গেও বলেছিলেন, এর পাঠসূচি দুর্বল।
আজকের দিনে ইসলামের অনুসন্ধিৎসুদের মাওলানা আজাদের মতো পণ্ডিতদের পর্যবেক্ষণ থেকে শেখা প্রয়োজন। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা, নিজস্ব পরিবারের বুদ্ধিবৃত্তি এবং প্রথাগত ও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে তার লেখনী আর প্রশ্ন উত্থাপন উভয় দিকই শিক্ষণীয়।
এস. ইরফান হাবিব: দিল্লির ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশনাল প্লানিং এন্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মাওলানা আবুল কালাম আজাদ চেয়ারের সভাপতি
- ছবি- ইন্টারনেট