একজীবনে মানুষের পরিচয় কয়টা হতে পারে? এর নির্দিষ্ট কোনো উত্তর হয়তো নেই। তবে আমরা একটা পরিচয় দিয়েই অনেককে চিনি। ব্যক্তির এক পরিচয়ই তাকে বহন করে। এর বাইরেও বহুবিধ পরিচয়ের অধিকারী মানুষ থাকেন। যারা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, প্রতিভার বিভিন্ন শাখায় তাদের অবদান স্বমহিমায় উজ্জ্বল। প্রতিভা দিয়েই তারা বেঁচে থাকেন ইতিহাসের পাতায়। তাদেরই একজন ওবায়দ উল হক। তিনি একাধারে সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চলিচ্চত্রকার। একই সঙ্গে লেখক, কবি, ঔপন্যাসিক, প্রযোজক, সুরকার ও গীতিকারও। তবে সবকিছু ছাপিয়ে সাংবাদিক পরিচয়ই তাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। যদিও তার সাংবাদিক হওয়ার ঘটনা কিছুটা চমকপ্রদ।
সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবনের সূচনা। সেটা ১৯৩৮ সালে। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর ওবায়েদ উল হক চলে আসেন ঢাকায়। এর আগেই তিনি ১৯৪৩ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে চলিচ্চত্রাঙ্গনে প্রবেশ করেন। ১৯৪৬ সালে মুক্তি পায় তার ছবি। বাংলা, বিহার, আসাম ও বার্মায় তার ছবি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ছবি বানিয়ে সফলতা পেলেও ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরই তাকে ছাড়তে হয় চলচ্চিত্রাঙ্গন।
ওবায়েদ উল হক পাকিস্তান অবজারভারে লেখালেখি করতেন। সে সূত্র ধরে ১৯৫১ সালের একটি চিঠিই তার জীবন ঘুরিয়ে দেয়। পাকিস্তান অবজারভারের সম্পাদক আবদুস সালাম তাকে তার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে চাকরির আমনন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি লেখেন। ওবায়েদ উল হক প্রথমে বিষয়টি গুরুত্ব দেননি। কিন্তু সম্পাদক তাকে ছাড়ার পাত্র নন। আবার টেলিগ্রাম পাঠালেন। এবার আর ফেলে দিতে পরলেন না। সেই থেকে তার সাংবাদিকতার শুরু। ঘটনাচক্রে সাংবাদিকতায় এলেও ভালোবেসে ফেলেন পেশাটিকে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখানে তিনি পার করেন জীবনের পঞ্চাশ বছর। ১৯৫১ থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত বিশ বছর তার লড়াই চলে কলমে। দেশ স্বাধীন হলে ওবায়েদ উল হক সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করেন; ১৯৭২ হতে ১৯৮৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ অবজারভারের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার পরিচালনায় পত্রিকাটি বিশেষ গতি পায়, জনপ্রিয় দৈনিক হিসেবে তখন এটি ছিল অনন্য।
এর পর সম্পাদক হিসেবে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন ডেইলি নিউজ নামে আরেকটি নতুন দৈনিকে। তার সাংবাদিকতা অবশ্য এখানেই শেষ হয়নি। তিনি দৈনিক বাংলা ও বাংলাদেশ টাইমস পত্রিকার ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া তারই প্রচেষ্টায় সাংবাদিকদের প্রশিণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি)। প্রতিষ্ঠানটির প্রথম চেয়ারম্যানও ওবায়েদ উল হক। অবশ্য তার পড়াশোনার ক্ষেত্র ছিল ভিন্ন। দর্শনে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আর ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন আইনে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ নানা পদে দায়িত্ব পালন করেন কৃতী এই মানুষটি। কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে নানা সম্মাননাও পেয়েছেন তিনি। সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক পেয়েছেন। পেয়েছেন বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, মার্কেন্টাইল ব্যাংক সম্মাননা, ইউনিসেফ স্বর্ণপদকসহ অনেক পুরস্কার। লিখেছেন ৬টি নাটক, ৩টি উপন্যাস, ৪টি কাব্যগ্রন্থ।
১৯১১ সালে জন্মগ্রহণকারী ওবায়েদ উল হক ৯৬ বছর বয়সে ২০০৭ সালের ১৩ অক্টোবর দুনিয়ার মায়া ছেড়ে পাড়ি জমান পারাপারে। তার প্রতি শ্রদ্ধা।
- সমকালে প্রকাশিত, ১৩ অক্টোবর ২০১৩
- ই-সমকাল হতে দেখুন
- ছবি- ইন্টারনেট