Mahfuzur Rahman Manik
আহাজারির শেষ নেই...
এপ্রিল 25, 2013

Rescue workers try to rescue trapped garment workers in the Rana Plaza building which collapsed, in Savarঘটনার প্রাথমিক পর্যায়ে লেখাটি এভাবে শুরু করতে চেয়েছিলাম...
দুর্ঘটনার হাত পা নেই। এটা বলে কয়ে আসেনা। তারপরও দুর্ঘটনার জন্য সবাই প্রস্তুত থাকে। কোথাও তা ঘটার আশংকা থাকলে তার হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যেমন ট্রাকের পেছনে লেখা থাকে ‘১০০ হাত দূরে থাকুন’ কিংবা লঞ্চে আমরা লাইফবোট দেখি, বিভিন্ন ভবনে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রও দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচার প্রস্তুতি। তা ঘটুক আর না ঘটুক অনেক আগ থেকেই এসব প্রস্তুতি আমরা দেখছি। আর দুর্ঘটনা নিশ্চিত ঘটবে এরকম আশংকা থাকলে তা থেকে বাঁচার জন্য কেমন প্রস্তুতি হতে পারে বলাই বাহুল্য। নিশ্চিত ঘটার আশংকা থাকা সত্ত্বেও সতর্কতা বা কোনোরূপ প্রস্তুতি গ্রহন না করার কথা আমরা চিন্তাও করতে পারিনা। আর এরকম অপ্রস্তুত অবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটলে তার ভয়াবহতাও আমাদের কল্পনার বাইরে। ঠিক এ ঘটনাই ঘটলো সাভার।
কিন্তু দিন যত গড়ালো হিসেবও দ্রুত পাল্টালো। সেই সঙ্গে শুরুটা পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।আসলে সাভারের ঘটনাতো নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়। যেটি বর্ণনায় কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম এক-দুই কথায় বলছে ‘সাভার ট্রাজেডি কিংবা রানা প্লাজা ট্রাজেডি’। এ অভিধাও কেমন যেন যুৎসই নয়। এতগুলো তাজা প্রাণকে যেভাবে খুন করা হলো এর জন্য অন্যকোন অভিধা খুজতে হবে। যাহোক, তারপরও শুরু করলাম এভাবে...
২৪ এপ্রিল বুধবার সকাল থেকেই চোখ দুটি টেলিভিশনের পর্দায়। দেখতে দেখতে চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে। এ কী দেখছি! সাভারে রানা প্লাজা নামে একটি নয়তলা ভবন ধসে পড়েছে। উদ্ধারকর্মী আর সংবাদমাধ্যম কর্মীদের ভিড়। বেলা যত বাড়ছে তত বাড়ছে লাশের সংখ্যা। বের হচ্ছে নিহত মানুষের দেহ। এর সঙ্গে আহত শ্রমিকদের আহাজারি যোগ হয়ে যে হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য।
টিভির পর্দার বাইরে অনলাইনে সংবাদ দেখছি। লাশের সংখ্যা বারবার আপডেট করছেন তারা। দুপুর নাগাদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংখ্যাটা জানালেন ৭০। সংবাদমাধ্যমও আপডেট দিলো সংখ্যাটি। যদিও স্থানীয় এনাম মেডিকেল কলেজেই ৭৬ জনের লাশের কথা বলছিলেন সেখানকার চিকিৎসক। শেষ পর্যন্ত আপডেট কোথায় থামবে, কেউ বলতে পারে না।
সংবাদটি ততক্ষণে আর দেশে সীমাবদ্ধ নেই। প্রতিবেশী টাইমস অব ইন্ডিয়া ছাড়িয়ে পেঁৗছে গেছে নিউইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ানসহ বিশ্বের সব সংবাদমাধ্যমের কাছে। বিবিসি আর আলজাজিরা তো লিড করেছে। একই সঙ্গে সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াল ঘটনাটি। কীভাবে এ রকম একটা নির্মম ঘটনা ঘটল, এটাই সবার প্রশ্ন। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ইতিমধ্যে বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য দেওয়া শুরু করেছেন। বিশেষ করে ভবনের নিরাপত্তা, ভবন নির্মাণে ত্রুটি, যাবতীয় বিষয় তারা বলছেন। মাঝে মধ্যে রানা প্লাজার আপডেট দেখছি। শত শত মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে ঠিকই, এর চেয়ে বেশি যে আটকা পড়ে আছে সেটাও বোঝা গেল। একজন টিভি প্রতিবেদক আটকা পড়া মানুষের কাছে মাইক্রোফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, কেউ আছে কি-না, শোনা গেল অনেক মানুষের কণ্ঠ। কেউ তার নাম বলছেন, কেউ বলছেন বাঁচান। ধ্বংসস্তূপের নিচের মানুষের কাছে বোতল বোতল পানি দেওয়ার দৃশ্যও চোখে পড়ল।
দুর্ঘটনাটি যে দায়িত্বহীনতার ফল তা বোঝা গেল। আগের দিনই ভবনে ফাটল দেখা দেওয়ার কারণে সেখানে থাকা ব্র্যাক ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া হয়। অথচ সেখানকার গার্মেন্ট শ্রমিকদের লাঠি দেখিয়ে ভবনে তোলা হয়েছে বলে হাসপাতালে আহত শ্রমিকরা জানিয়েছেন। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কথা জেনেও তাদের এভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের প্রতি এ রকম নির্মমতার ফলশ্রুতিতে প্রায়ই তাদের মৃত্যুর শিকার হতে হয়। এই বর্বরতার যেন শেষ নেই। সাভারের ঘটনাকে যেমন ভবনের ত্রুটির কথা বলে শেষ করা যাবে না, তেমনি শ্রমিকদের প্রতি বরাবরের অবহেলাও দেখতে হবে।
আহাজারি আর আহাজারিই এখন সাভারের দৃশ্য। হাসপাতালে আহতদের আহাজারি, স্বজনদের আহাজারি আর আটকে পড়া মানুষের বাঁচার আকুতি। এর যেন শেষ নেই। Ahajari-Savar-tragedyলেখাটি এভাবেই শেষ করলাম।
কিন্তু দ্বিতীয় দিনের আপডেট যখন জানছি, বুঝলাম লেখাটি খুব একটা মজবুত হয়নি। বিশেষ করে দুপুর একটায়ই সমকাল যখন জানা গেলো ২০০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আর আহত উদ্ধার করা হয়েছে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ। তখন আমার মাথা ঘুরছে। উদ্ধার কাজ চলছে এবং চাপা পড়া আরও মানুষের আর্তনাদ যেন আমাকে আর ধরে রাখতে পারছেনা। সংখ্যাটা কোথায় দাঁড়াবে তাও কল্পনা করতে পারছিনা। এতবেশি হতাহতের ঘটনা এই ক্ষুদ্র জীবনে দ্বিতীয়টি দেখেছি কিনা জানিনা। আর এত মানুষের লাশ নিয়ে কেমন লেখা হতে পারে তাও আমার জানা নেই। শিরোনামটা যা আছে থাক। কিন্তু প্রশ্নটা হলো- মঙ্গলবার রানা প্লাজার ফাটলের খবর শুনে গার্মেন্টসহ সেখানকার সকল প্রতিষ্ঠানের ছুটি ঘোষণা করা হয়। সেই ভবনেই কোনো যাচাই বাছাই ছাড়াই বুধবার একেবারে মাইকে ঘোষণা দিয়ে ভবন এবং গার্মেন্টের মালিকরা শ্রমিকদের ভবনে কাজ করার জন্য ডেকে এনেছেন। এবং জোর করে ভবনে ঢুকিয়ে তাদের মৃত্যুর বন্দোবস্ত করেছেন- এই হত্যাকারীদের কিছু হবেনা?

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।