Mahfuzur Rahman Manik
ছবির ভাষা
ফেব্রুয়ারী 4, 2013

Bookকেউ কথা বললে তার কথা আরেকজন পুরোপুরি নাও বুঝতে পারে, কারও লেখা অন্যের কাছে বোধগম্য নাও হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে 'কমিউনিকেশন গ্যাপ' থেকে যায়। ছবির ক্ষেত্রেও কি তাই? একটি নিশ্চল, নিস্তব্ধ ছবির দিকে তাকিয়ে গল্প-উপন্যাস-টেলিভিশনে কতজনকে কাঁদতে দেখেছি। দেয়ালে সাঁটানো কিংবা টেবিলে রাখা কোনো ছবিতে চুমু খেয়েছেন কতজন। নিজেও তো কত ছবির দিকে একটানা তাকিয়ে থেকেছি; যেন জীবন্ত, যেন কথা বলতে চায়, যেন বলে ফেলবে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন, যেন আমাকেও পরখ করছে। ছবির ভাষাই বোধহয় এ রকম। সবাই বোঝেন। যে শিশুটির বাবা কিংবা মা মারা গেছে, তাদের ছবিটা দেখেও শিশুটি হয়তো কাঁদবে। আসলে ছবি তো কেবল কথাই বলে না, একটা আবেগ তৈরি করে, একটা বাস্তব বিষয়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
বৃহস্পতিবার সমকালের ছবিটা তার চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু? প্রথম পাতার একেবারে ওপরে ডানদিকের ছবিটা। 'কী সুন্দর নতুন বই' শিরোনাম হলেও ক্যাপশনের কথাগুলো অতটা ভালো লাগার কথা নয় 'নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের হাতে ইতিমধ্যেই পেঁৗছেছে বেশিরভাগ নতুন বই। কিন্তু শিক্ষাবঞ্চিত যে পথশিশু রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা নতুন বই দেখছে কৌতূহলভরে, ওরা কি কোনোদিন স্কুলে গিয়ে এই বই পড়ার সুযোগ পাবে?' ছবিশিল্পী কাজল হাজরা রাজধানীর গেণ্ডারিয়া থেকে ছবিটি তুলেছেন। দুটি পথশিশু কী কৌতূহলভরে দেখছে বইগুলো। তাদের বয়সে থেকে চিন্তা করা যাক, নতুন বই যেন নতুন চাঁদ, পড়াশোনায় নতুন উদ্যম। নতুন বইয়ের একটা গন্ধ আছে সেটাও অনেকের প্রিয়। শিশুরা এমনিতেই নতুনের পূজারি, নতুন ক্লাস, সে সঙ্গে নতুন বই হলে তো কথাই নেই। কিন্তু এসব থেকে বঞ্চিত এই দুই পথশিশু। যাদের হয়তো খাবারেরই নিশ্চয়তা নেই, ঘুমানোর জায়গা নেই, প্রয়োজনীয় পরিচ্ছেদ নেই। তাদের কাছে নতুন বই সে তো স্বপ্ন, চাঁদ ছোঁয়ার স্বপ্ন।
ছবিটি রাজধানীর একটি জায়গা থেকে তোলা হলেও কিংবা ছবিতে দু'জন শিক্ষাবঞ্চিত পথশিশুকে দেখা গেলেও তারা গোটা দেশের লাখো পথশিশুর প্রতিনিধিত্বকারী। গত জুনে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন তরফে জানা গেল, দেশে বর্তমান পথশিশুর সংখ্যা দশ লাখ। সংখ্যাটি ২০১৪ সাল নাগাদ ১২ লাখে পেঁৗছবে বলছে প্রতিবেদনটি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর নানা তথ্যও উঠে এসেছে সেখানে_ পথশিশুদের রাতে ঘুমানোর জন্য ৪১ ভাগ শিশুর কোনো বিছানা নেই, প্রায় ৪০ ভাগ প্রতিদিন গোসল করতে পারে না, ৩৫ ভাগ শিশু খোলা জায়গায় পায়খানা করে। কোনো মতে খাবার জোগাড়ের জন্য ৮০ ভাগ পথশিশু বিভিন্ন ধরনের কাজ করে, ৮৪ ভাগের কোনো শীতবস্ত্র নেই। অসুস্থ হলে প্রায় ৫৪ ভাগের দেখাশোনার জন্য কেউ নেই। অর্থের অভাবে পথশিশুদের ৭৫ ভাগ ডাক্তারের কাছে যেতে পারে না।
ছবি কেন, এর বাইরে তো প্রতিনিয়ত হাজারো পথশিশু রাজধানীর নানা জায়গায় আমরা দেখি। সে বাস্তব দৃশ্যও ছবির মতোই মনে হয়। মনে হয়, তারা তো এখানে থাকার কথা নয়; সত্যিই কি এভাবে শুয়ে আছে শিশুটি? যখন সামনে হাঁটি তারপরও সেটা ছবির মতো ভেসে বেড়ায় মস্তিষ্কে। সমকালের ছবিটিও ভেসে বেড়াচ্ছে। তবে বেশি মনে পড়ছে ক্যাপশনের প্রশ্নটি_ 'ওরা কি কোনোদিন স্কুলে গিয়ে এই বই পড়ার সুযোগ পাবে?'

সমকালে প্রকাশিত, ২০ জানুয়ারি ২০১৩
ছবি: সমকাল

ট্যাগঃ , , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।