ঘড়ি বলছে, ৩টা বাজতে ১৫ মিনিট বাকি আছে। ব্যাংক বলে কথা; দেরি করে ফেললাম কি না ভেবে দ্রুত ঢুকলাম। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের একটি শাখা। ঢুকে বুঝলাম, দেরি করিনি। কারণ অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। এ ছাড়া টাকা নগদ প্রদান-গ্রহণের তিনটি কাউন্টারের দুটিই খালি। স্বস্তি পেলাম কিছুটা। কিন্তু কাছে গিয়ে যা দেখলাম, তা না বলার মতো নয়। তার আগে ব্যাংকের ভেতরকার অবস্থা বর্ণনা করা যাক।
কর্মকর্তা আছেন ১৫ জনের মতো। কাচ দিয়ে ঘেরা দুটি কক্ষ। একটিতে কর্মকর্তা গোছের একজন। ঢুকলেই বাম পাশে তার কক্ষ। বিপরীতে আছে চারজনের চারটা টেবিলসহ চেয়ার। এর পরই কাচ দিয়ে ঘেরা টাকা নগদ প্রদান ও গ্রহণের কাউন্টার। এখানে সরাসরি গ্রাহকের সঙ্গে আদান-প্রদানে আছেন তিনজন। এ ছাড়া আরেকজন আছেন, যিনি চেক ভেরিফাই করেন। আর এ কাচঘেরা কক্ষের বাম পাশেই আরেক কর্মকর্তা বসে আছেন।
মূল বিষয়ে আসি। কাচ দিয়ে ঘেরা টাকা নগদ প্রদান ও গ্রহণের কাউন্টারে আমার কাজ। দেখলাম অন্য সব কর্মকর্তা নিজস্ব চেয়ারে আসীন, কিন্তু এখানে আছেন তিনজনের জায়গায় একজন, যেটা আগেই বলা হয়েছে। যাকে পেলাম তিনি মুরব্বিই বলতে হবে। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত। বয়স ৫০-এর কম হবে না। অবশ্য তার পেছনে চেক ভেরিফায়ার কিছুটা মুড নিয়ে আছেন, ভাবখানা এমন— আমি কিন্তু বস।
যাহোক, এক গ্রাহক কয়েক বান্ডিল টাকা নিয়ে এসেছেন। ৫০, ২০ ও ১০ টাকার বান্ডিল। বান্ডিলসংখ্যা শ’খানেক তো হবেই। মুরব্বি আর কী করবেন, বসে বসে টাকা গুনছেন। গুনছেন তো গুনছেনই, অন্যদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। এদিকে অন্য গ্রাহকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। গ্রাহকদের মধ্যে কিছুটা আলোচনা চলছে, এ লোকটা কী করছেন পাঁচ-দশ মিনিট ধরে— একজনের টাকাই গুনে যাচ্ছেন? অন্য কারও প্রতি তার নজর নেই।
আমি ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে এ অবস্থা দেখছি আর হাসছি। কারণ এখানে একটাও মানি কাউন্টিং মেশিন নেই। তার হাতে যে টাকা, তা গুনতে আরও অন্তত ২০ মিনিট লাগার কথা। এ রকম অবস্থায় গ্রাহকদের অস্বস্তিটা একটু বেড়েছে। মুরব্বি মনে হয় এবার একটু তাকালেন। বললেন, ‘ভাই কী করব? আমি একা, আবার টাকা গোনার মেশিনও নেই।’ অবশ্য পেছনের ব্যক্তির খবর নেই। গভীর মনোযোগের সঙ্গে কম্পিউটারে কাজ করেই যাচ্ছেন।
কাচের বাইরে কাউন্টারে আমরা যারা অপেক্ষমাণ, তাদের সংখ্যা এতক্ষণে ২০ হয়ে গেছে। আমাদের সামনে এবং ওই কর্মকর্তাদের পেছনে একটা দেয়াল, যেখানে ব্যাংকের লোগোসহ লেখা আছে স্লোগান। সেটা পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মন্তব্য করছেন, ‘অগ্রগতি মানে পিছিয়ে যাওয়া’! ‘সবাই যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের তখন এই দুর্গতি’ তিনি যোগ করলেন। আরেকজন বলছেন, ‘অগ্রগতি তো বটেই, ওই যে দেখেন না নষ্ট মেশিনটা পড়ে আছে’ (আসলেই লেখাটার নিচে নষ্ট একটা টাকা গোনার মেশিন পড়ে ছিল)।
ততক্ষণে শোরগোলটা আরও স্পষ্ট হয়েছে। গ্রাহকরা বলছেন, ‘ওই মিয়া, আপনার টাকা গোনা রাখেন। আমাদের আগে বিদায় করেন। এতক্ষণে তো আমাদের কাজ হয়ে যেত।’ আওয়াজ আরও বেড়েছে। এবার মনে হয় ভদ্রলোকের টনক নড়েছে। যার টাকা গুনছেন, তাকে সবাই ম্যানেজ করলেন। এবার অন্যদের সেবা দেয়া শুরু করলেন তিনি।
এরই মধ্যে সময় ৩টা পেরিয়ে গেছে। মুরব্বির সঙ্গে দুটি খালি চেয়ারের একটা পূর্ণ হলো— এক
ভদ্রমহিলা বসলেন সেখানে। মাঝখানে একটি চেয়ার কিন্তু খালি। খালি কেন? উত্তরটা জানা গেল, ‘এই চেয়ারের উনি বদলি হয়েছেন’— একজন গ্রাহকই বললেন। এবার দুজন মিলেই সবার সেবা দেয়া শুরু করলেন। টাকা গোনার মেশিন নেই, হাতেই গুনে গুনে সেবা দিচ্ছেন। দেরি তো একটু হবেই। তবু মুরব্বির চাপটা যে কমল কিংবা তিনি যে ভরসা পেলেন, তা তার পরবর্তী কিছুটা দ্রুত কর্মকাণ্ডেই বোঝা গেল।
বেশি নয়, মাত্র ২৫ মিনিট দাঁড়িয়ে এবার আমার পালা। চেকটা পেয়েই মুরব্বি তার কাজ শেষ করে ভেরিফায়ারের কাছে দিলেন। চেক দেখে তার ভঙ্গিতে বুঝলাম, কিছুটা সমস্যা আছে। পাঁচ মিনিট ধরে দেখলাম চেকটা বিভিন্ন কর্মকর্তার হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত আমার হাতে এল। না, তারা কোনো সমাধান করতে রাজি হননি। কেন হননি, কী সমস্যা, সেটা এখন থাক। তবে ব্যাংক থেকে বের হতে পেরেছি, এটাই আমার জন্য আনন্দের।