Mahfuzur Rahman Manik
ডিজিটাল ক্যাম্পাস কতদূর

কম্পিউটার ওয়ার্ল্ড ডট কম ২০০৮ সালের ৬ অক্টোবর একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জরিপের শিরোনামটা বাংলায়- ‘ওয়াইফাই কলেজ শিার্থীদের অধিক নাম্বার পেতে সাহায্য করে’। আমেরিকার ৫০১ জন কলেজ শিার্থীর ওপর করা গবেষণার ফলাফল এটি। ৭৫ ভাগ শিার্থীই মনে করে, তাদের পরীার গ্রেড বাড়াতে ওয়াইফাই এর ভূমিকা অনেক। ৪৮ ভাগ শিার্থী তো বলেই দিয়েছে, তারা বিয়ার খাওয়া ত্যাগ করতে পারলেও ওয়াইফাই ত্যাগ করতে পারবেনা।
২০০৮ সালে আমেরিকার কলেজ শিার্থীদের যখন এই অবস্থা, তখন বাংলাদেশের কলেজ শিার্থীদের অবস্থা কী। আলোচনার প্রাসঙ্গিকতার জন্য কলেজের বিষয়ে যাওয়ার আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা দেখবো।
সম্প্রতি বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো যখন তাদের ফ্যাট বিক্রির বিজ্ঞাপনে নাগরিক সুবিধার তালিকায় ‘ওয়াইফাই’ কে যুক্ত করেছে, তা দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা একজন শিার্থী আফসোস করে বলছে ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থেকেও ওয়াইফাই সুবিধা পাচ্ছিনা, আর তা এখন অনেকে বাসায় বসেই পাবে।’ বলা যেতে পারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ওয়াইফাই সুবিধা আছে। আছে বটে। ১৭ টি হলের মধ্যে তিন-চারটি হলে, টিএসসিতে, ১১ টি অনুষদের মধ্যে দু’একটিতে আর নয়টি ইনস্টিটিউটের মধ্যে একটিতে। তা ও এগুলো বিচ্ছিন্ন এবং বিপ্তি। কেন্দ্রিয়ভাবে এখানে ওয়াইফাই নেই।
অন্য ক্যাম্পাসগুলোর মধ্যে বুয়েটের একাডেমিক বিল্ডিং এ, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। সম্প্রতি দেয়া হয়েছে রাজশাহী আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রাইভেট কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচ্ছিন্নভাবে থাকলেও নেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় আঠারশ’ ক্যাম্পাসের কথা বাদই দিলাম।
অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রায় সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে ওয়াইফাই। অনেক আগ থেকেই। এখন থেকে ১২ বছর আগে ১৯৯৯ সালে কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটি প্রথম তাদের পিটাসবার্গ ক্যাম্পাসে এ সেবা চালু করে। এরপর ২০০০ সালে আমেরিকার ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটি গোটা ক্যাম্পাস জুড়ে ওয়াইফাই সেবা দেয়ার মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টি করে। এভাবে ধীরে ধীরে প্রায় সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় এ সেবা শিার্থীদের প্রদান করে। আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও রয়েছে সেবাটি। ইন্ডিয়া, পাকিান, শ্রীলংকা এমনকি থাইল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়তে কেন্দ্রীয়ভাবে রয়েছে ওয়াইফাই।
রাজধানীর ঢাকার ওয়াইফাই চিত্র নিয়ে গত ২ জানুয়ারি প্রথম আলো ঢাকার পাতায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি দেখাচ্ছে ঢকার পাঁচতারা হোটেল, অভিজাত রেঁস্তোরা আর বিমানবন্দর এলাকায় রয়েছে ওয়াইফাই। বিভিন্ন নামিদামি কর্পোরেট হাউজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এখন নিজস্ব ফ্যাটেও ওয়াইফাই দেখছি। সন্দেহ নেই ঢাকা এগিয়ে যাচ্ছে, পিছিয়ে পড়ছে ক্যাম্পাসগুলো। অথচ এদিকথেকে তাদেরই এগিয়ে থাকার কথা ছিলো।
গত ১২ নভেম্বর প্রথম আলোর কম্পিউটার প্রতিদিন পাতার ছোট্ট একটা সংবাদ, ‘যুক্তরাজ্য জুড়ে বিনামূল্যে ওয়াইফাই। সংবাদ ভাষ্যমতে, যুক্তরাজ্যে ইন্টারনেট সপ্তাহ পালন উপলে এসেবা দিয়েছে ইন্টারনেট ভিত্তিক কথা বলার ওয়েবসাইট স্কাইপ। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। কারন যুক্তরাজ্য কিংবা যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, বিশ্বের অনেক শহরেই রয়েছে পাবলিক ওয়াইফাই সেবা। ২০০৮ সাল পর্যন্ত উইকিপিডিয়া দেখিয়েছে, ৩০০ মেট্রোপলিটন এলাকায় এ সেবা আছে। এমনকি ২০১০ সালে চেক প্রজাতন্ত্রে ১১৫০ টিরও বেশি ওয়াইফাই ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে।
গত বছরের শেষ দিকে বিবিসি একটা জরিপে বলছে, মানুষ মনে করে ইন্টারনেট সেবা পাওয়াটাও তার একটা মানবাধিকার। যদি তা-ই হয়, বাংলাদেশের মানুষ এ অধিকার থেকে কতটা বঞ্চিত, বলার অপো রাখেনা। সাধারণ মানুষের কথা বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিার্থীদের অবস্থা দেখলেও হতাশ হতে হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষবর্ষের একজন শিার্থীকে তার ইমেইল এড্রেস আছে কিনা, প্রশ্ন করলে উত্তরে ‘না’ আসলেও অবাক হওয়ার মত কিছুই থাকবেনা। ক্যাম্পাসগুলো এখনো বিজ্ঞান-প্রযুক্তি থেকে অনেক পিছিয়ে। মূল গলদটা কিন্তু প্রশাসনে। প্রশাসনিক অনেক কাঠামোই এখনো পুরনো অ্যানালগ পদ্ধতিতেই ঢিমেতালে চলছে।
ওয়াইফাই এর কথা বাদ দিলেও শিার্থীদের ইন্টারনেট সেবাও ভালোভাবে দিচ্ছেনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। গোটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে সাইবার সেন্টার মাত্র দু’টি। ত্রিশ হাজার শিার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে এগুলোর ধারণ মতা ৬০। তাও আবার অনেক উচ্চমূল্য পরিশোধ করতে হয় শিার্থীদের।
অনেক আগ থেকেই আমরা একটা কথা শুনে আসছি- শিার্থীদের জন্য সরকার দশ হাজার টাকায় ল্যাপটপ দিচ্ছে। ডেডলাইনের পর ডেডলাইন শেষ হচ্ছে কিন্তু ল্যাপটপ মিলছেনা। ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য আগে ডিজিটালের ক্যাম্পাসের কথা বাদই দিলাম। আজকের পৃথিবী ইন্টারনেট ভিত্তিক এতবেশি এগিয়েছে, একজন শিার্থী এখন তার পড়াশোনা, গবেষনা এমনকি প্রাত্যহিক কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার না করলে অবশ্যম্ভাবি ভাবে সে পিছিয়ে পড়বে।
আজকে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থাই এরকম, সেখানে স্কুল কলেজের কথা বলার অপো রাখেনা। সে বিষয়ে কালের কন্ঠ (৭ এপ্রিল) বলছে, ৩২ হাজার শিা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ইন্টারনেট নেই ২৯ হাজার প্রতিষ্ঠানে। প্রতিবেদনটি দেখাচ্ছে- দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের ৩২ হাজার ৫৭৭ টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিদ্যুৎ নেই সাত হাজার ১৮৮ টিতে। কম্পিউটার নেই ১৩ হাজার ৬৫৩ টিতে। আর ইন্টারেনট সংযোগ নেই ২৯ হাজার ৩৪২ টিতে।
এ কথা অবশ্য ঠিক, ওয়াইফাই বলি আর ইন্টারনেট ভিত্তিক কিংবা ডিজিটাল ক্যাম্পাস বলি, তার প্রচেষ্টার জোয়ারটা অন্তত সাম্প্রতিক সময়েরই। সমস্যা হলো কাজটা দ্রুত এগুচ্ছেনা। অঙ্গীকারের মধ্যেই অনেক কিছু থেমে আছে।
গোটা পৃথিবী যত দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে, এসব কাজে আমাদের গতি কচ্ছপের গতির চেয়েও কম। ফলে আমরা পিছিয়ে। এখনও আমাদের বলতে হচ্ছে- আর কতদূর ডিজিটাল ক্যাম্পাসের স্বপ্ন।

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।