Mahfuzur Rahman Manik
কোথায় যাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
এপ্রিল 30, 2011

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যুগান্তর ১৯-২৩ এপ্রিল সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। মূল শিরোনাম আশা-নিরাশার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হলেও, পাঁচটি প্রতিবেদনের কোনটিতেই হতাশা ছাড়া আশার আলো নেই। ‘জরাগ্রস্ত প্রশাসন : সর্বত্র অনিয়ম দুর্নীতি আর তুঘলকি কারবার, আর্থিক সচ্ছলতাই প্রতিষ্ঠানটির কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, শিক্ষা কার্যক্রমে মহানৈরাজ্য আর আঞ্চলিক কেন্দ্র দুর্নীতি বাড়াবে কিংবা কলেজ পরিদর্শন ও কারিকুলাম শাখার কারণেই শিক্ষার মানে অধোগতি’ প্রতিবেদনগুলোর শিরোনামই নিরাশার কথা বলে দেয়। আলোচনার জন্য প্রতিটি প্রতিবেদনই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্লেষণের সুবিধার্থে এবং বিষয়ের গভীরতার জন্য এখন মূল ফোকাস থাকবে ‘শিক্ষা কার্যক্রমে মহানৈরাজ্য’ প্রতিবেদনটি। আর এ নৈরাজ্য আলোচনার মাধ্যমেই ‘কান টানলে মাথা আসবে’ সূত্রে অন্যান্য প্রতিবেদনের বিষয়ও চলে আসবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে নৈরাজ্যের স্পষ্ট নিদর্শন হল সেশনজট, ইংরেজিতে সেশনজ্যাম। ইন্টারনেটের কল্যাণে সেশনজ্যাম পরিভাষাটিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করা গেছে, তা হল এ পরিভাষাটি বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও ব্যবহার হয় না। গুগলে সেশনজ্যাম (session jam) লিখে অনুসন্ধান করলে যতগুলো ফলাফল আসবে সবক’টির সারাংশ বাংলা করলে দাঁড়ায়Ñ ‘সেশনজ্যাম বাংলাদেশে ব্যাপক প্রচলিত একটি পরিভাষা, যেটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সহিংসতা বা অন্য কোন কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ থাকাকে বোঝায়’।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট নিয়ে অনেক আগ থেকেই গণমাধ্যম সোচ্চার। ফলে গত ২৬ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়টি সেশনজট ও পরীক্ষার ফল বিলম্বে প্রকাশের কারণ অনুসন্ধানে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করে। সম্প্র্রতি (২৭ মার্চ) কমিটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যা বলছেÑ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল বিলম্বে প্রকাশের এবং সেশনজটের মূল কারণ পর্যবেক্ষণ ও আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয়ের অভাব। যুগান্তরের প্রতিবেদনটি প্রথমদিকে এ বিষয়টিই বলছেÑ ‘কলেজগুলোতে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে কিনা, শিক্ষকরা কী পড়াচ্ছেন, যা পড়াচ্ছেন তা সিলেবাসে আছে কিনা, নিয়মিত ক্লাস ও পাঠদান হচ্ছে কিনা, সিলেবাসটাইবা যুগোপযোগী কিনা, শিক্ষার্থী সময়মতো শিক্ষাজীবন শেষ করে বেরিয়ে যেতে পারছে কিনা, পরীক্ষার খাতায় যা লিখল, সে অনুযায়ী নম্বর পাবে কিনা কোন কিছুরই নিশ্চয়তা নেই।’ অর্থাৎ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে তার নিয়মিত কর্মযজ্ঞ ক্লাস, পরীক্ষা, ফলাফল ইত্যাদি দেখার কেউ নেই। ফলে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি পরীক্ষা-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এতদিন পর প্রশাসনের হুঁশ ফিরেছে। অথচ ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ গেজেটের ৩৭ নম্বর আইন অনুসারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ই সৃষ্টি হয়েছে সমস্যা সমাধানের জন্য। প্রায় দুই দশক পরও সমস্যার শনি ছাড়েনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের।
যুগান্তরের প্রতিবেদনের আগে ২১ মার্চ ‘সেশনজট কুরে খাচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবন’ শিরোনামে প্রথম আলো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উভয় প্রতিবেদন দেখাচ্ছে, বিভাগ ও পরীক্ষা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়টির তিন বছরের সেশনজট রয়েছে। এখানে চার বছরের øাতক কোর্স শেষ হতে লাগছে সাত বছর। তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স শেষ হতে লেগে যাচ্ছে ছয় বছর। আর øাতকোত্তর পর্যায়ের ফল প্রকাশ হতেই এক বছরের বেশি সময় লাগছে। যুগান্তর দেখাচ্ছে সেশনজটের অন্যতম কারণ বিলম্বে ফল প্রকাশ।
আপাতদৃষ্টিতে সেশজটের কারণ বিলম্বে ফল প্রকাশ কিংবা সমন্বয়হীনতা হলেও গোড়ার সমস্যা কিন্তু অন্যখানে, যেগুলো পুরো পাঁচটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রথমত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখন জরাগ্রস্ত। এখানে দুর্নীতি আর অনিয়মই নিয়ম। প্রতিষ্ঠানের মাথা প্রশাসন যখন অসুস্থ, তখন গোটা প্রতিষ্ঠানটিই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দ্বিতীয়ত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নজর নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি। তারা নিয়মিত অফিস করেন না। এ ছাড়া ভুয়া ও অবৈধ নিয়োগের বিষয়টিও আছে। তৃতীয়ত তিন ধরনের কর্তৃপক্ষ চালাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টিÑ একাডেমিক দিক দেখে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষকদের বেতন দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) এবং শিক্ষক নিয়োগ দেয় সরকারি কলেজের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) ও বেসরকারি কলেজের ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। আর সরকারি কলেজ শিক্ষকদের বদলি, পদায়ন ও প্রমোশন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে সমন্বয়হীনতার বিষয়টিও আছে।
বিশ্বের বড় ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ধরা হয় ছাত্রসংখ্যার দিক দিয়ে বড়। দেশের উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়টির ভূমিকা বলার অপেক্ষা রাখে না। মধ্যবিত্ত আর নিুমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের স্বপ্নের স্থান এটি। বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইটে কলেজসংখ্যা এখনও দেখানো হচ্ছে এক হাজার ৬০০, যুগান্তর বলছে, কলেজসংখ্যা দুই হাজার ২০০। প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থী এখানে পড়াশোনা করে। মজার বিষয় হল, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ইংল্যান্ডের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে গঠিত হলেও এখন তেমন মিল পাওয়া যায় না। ১৮৩৬ সালে গঠিত লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় এখন ১৭৫ বছর অতিক্রম করছে। এর অধীনে কলেজসংখ্যা ১৯। প্রতিটি কলেজ নিজস্ব স্বায়ত্তশাসনে পরিচালিত, শিক্ষার্থীসংখ্যা এক লাখ ২০ হাজার। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির আরও ১০টি বিশেষায়িত গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে।
আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী বিষয়টিই তার দুর্বলতার কারণ। সেটা আর্থিক সচ্ছলতা। একটি প্রতিবেদন বলছে, এ সচ্ছলতাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এর আমানত জমা আছে ২৬০ কোটি টাকা। কর্মকর্তারা এ টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির বদলে নিজেদের উন্নতিতে ব্যস্ত। আশ্চর্যের বিষয় হল, ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি সেশনজটের একটা কারণ বের করেছে প্রশ্ন ছাপানো নিয়ে। বিভিন্ন পাবলিক ও পিএসসির পরীক্ষার কারণে নিজেদের সুবিধামতো সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রীয় ছাপাখানায় (বিজি প্রেস) প্রশ্ন ছাপাতে পারে না। বিষয়টা হাস্যকর হলেও সত্য। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বলে সরকারি ছাপাখানায় সিরিয়াল ধরে তাকে শিক্ষার্থীদের সেশনজটে ফেলতে হবে কেন? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ১০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য নিজস্ব ছাপাখানা করতেই পারে। তার যে ফান্ড আছে তা দিয়েই করতে পারে। এতে একদিকে তাদের সময়মতো কাজ হবে, অন্যদিকে সরকারি ছাপাখানার ওপর চাপও কমবে। এভাবে ফান্ডের টাকা যথার্থভাবে খরচ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা লাঘব করা যায়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল প্রশাসন জরাগ্রস্ত বলে তার অধীনে সব বিভাগের অবস্থাও খারাপ। নির্দিষ্টভাবে যুগান্তর তার শেষ প্রতিবেদনে কলেজ পরিদর্শন ও কারিকুলাম শাখার কথা বলেছে। প্রতিবেদনটি দেখিয়েছে, এখানে যথেষ্ট কর্মকর্তা নেই, নেই বিশেষজ্ঞ, ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে অধোগতি। বন্ধ আছে এর নিয়মিত কার্যক্রম, সঙ্গে গবেষণা কার্যক্রমও।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আঞ্চলিক কেন্দ্র করতে যাচ্ছে প্রশাসন। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ১ মে থেকে ছয়টি বিভাগীয় শহরে আঞ্চলিক কেন্দ্রের যাত্রা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। মূলত তত্ত্বাবধানের জন্যই বলা চলে এ বিকেন্দ্রীকরণ। ভর্তি ও পরীক্ষার কাজ হবে কেন্দ্রীয়ভাবে, বাকি কাজ আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো করবে। অবশ্য এ বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাব ২০০৯ থেকেই চলে আসছিল। এখন আর একজন শিক্ষার্থীকে যে কোন সমস্যায় গাজীপুর যেতে হবে না, তার আঞ্চলিক কেন্দ্রই সমাধান করবে। কিন্তু প্রতিবেদন বলছে ভিন্ন কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সূত্র দিয়ে এটি বলছে, আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো সেশনজট কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা তো কমাবেই না, উল্টো এগুলো ঝামেলা সৃষ্টি করবে এবং পরিণত হবে দুর্নীতির আখড়ায়। ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয়টির দুটি আঞ্চলিক কেন্দ্র খোলা হয়েছিল, যা ফলপ্রসূ হয়নি বরং গচ্চা গেছে ১৫ লাখ টাকা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যথা সর্বাঙ্গে। যথেষ্ট শিক্ষক নেই, নেই অবকাঠামো। চরম শিক্ষক সংকটেও যেসব শিক্ষক আছেন তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। পরীক্ষার খাতা ঠিকমতো দেন না। ফলে বিলম্বে ফল প্রকাশ হয়, সৃষ্টি হয় সেশনজট। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ব্যস্ত বাইরের কাজে। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি আর দলবাজিই এখন চলছে।
এ অবস্থায় কোথায় যাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থীর ভাগ্য কত দিন ঝুলে থাকবে তা ভাবার সময় এসেছে। সরকারের এ বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। এখন যে আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো হচ্ছে সেগুলো যাতে যথার্থভাবে কাজ করে তা দেখা দরকার। সব মিলিয়ে যুগান্তরের সম্পাদকীয়র সুরে বলা যায় একটি টাস্কফোর্স গঠন করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় অনিয়ম খতিয়ে দেখা দরকার।

দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত ৩০-০৪-২০১১

ট্যাগঃ

2 comments on “কোথায় যাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়”

  1. I have read. Actually season jam is the great problem arise in National University. Government should take immediate action to remove it! I support your last paragraph -প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থীর ভাগ্য কত দিন ঝুলে থাকবে তা ভাবার সময় এসেছে। সরকারের এ বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। এখন যে আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো হচ্ছে সেগুলো যাতে যথার্থভাবে কাজ করে তা দেখা দরকার। সব মিলিয়ে যুগান্তরের সম্পাদকীয়র সুরে বলা যায় একটি টাস্কফোর্স গঠন করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় অনিয়ম খতিয়ে দেখা দরকার।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।