Mahfuzur Rahman Manik
শতভাগ সাক্ষরতা কি শুধুই প্রতিশ্রুতি?
ফেব্রুয়ারী 23, 2011


সাক্ষরতা কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘ব্যুরো অব ননফরমাল এডুকেশন বা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো’। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট খুললেই একটি বাক্য নজরে পড়বে "We are Committed to
Ensure 100% literacy by 2014" বাংলা করলে যার অর্থ দাঁড়ায়- ২০১৪ সালের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতা নিশ্চিত করতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কথাটি শুধু এই ওয়েবসাইটেই নয়, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ইশতেহার, জাতীয় শিক্ষানীতিসহ অনেক বক্তব্যেও দেখা যায়। টার্গেট ২০১৪। স্বাভাবিকভাবেই ২০১১ এর এ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে সাক্ষরতার অবস্থা জানার কৌতুহল জাগবে। সাক্ষরতার হার নির্ণয়ে সর্বশেষ জরিপ হয়েছে ২০০৮ এর ডিসেম্বরে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং ইউনেস্কোর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘লিটারেসি অ্যাসেসমেন্ট সার্ভে’ জরিপে সাক্ষরতার হার দেখানো হয়েছে ৪৮.৮ ভাগ। উইকিপিডিয়ায় এখনও দেয়া আছে ৪৭.৫০ ভাগ। অবশ্য আমাদের প্রাথমিক ও গনশিক্ষা মন্ত্রনালয় বলছে সাক্ষরতার হার ৫৩ ভাগ।
এ হারকে ধরলেও এখনও ৪৭ ভাগ মানুষ নিরক্ষর। এ নিরক্ষর হারকে চার বছরে সাক্ষর করা কতটা সম্ভব। পেছনে ফেরা যাক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় সাক্ষরতার হার ছিলো ১৬.৮ ভাগ। স্বাধীনতার পরই সাক্ষরতার হার বাড়ানোর জন্য সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহন করা হয়। ১৯৯১ সালে অবস্থার পরিবর্তন হয়ে দাঁড়ায় ৩৫.৩ ভাগ। বিশ বছরে সাক্ষরতার হার বাড়ে ১৮.৫ ভাগ। বর্তমান ৫৩ ভাগ সাক্ষরতা ধরলে চল্লিশ বছরে বেড়েছে ৩৬.২ ভাগ। চল্লিশ বছরে যেখানে ছত্রিশ ভাগ বেড়েছে, সেখানে চার বছরে সাতচল্লিশ ভাগ অর্জন কতটা সহজ হবে।

সম্প্রতি ৮ ফেব্র“য়ারি সাক্ষরতা নিয়ে সমকাল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ নিয়ে পরেরদিন সম্পাদকীয়ও করেছে পত্রিকাটি। ‘চ্যালেঞ্জের মুখে নিরক্ষরতা দূরীকরণ কার্যক্রম’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয় সুত্রে বলেছে, নিরক্ষরতা দূরীকরণ কার্যক্রমের প্রকল্প অর্থের অভাবে সরকারের অনুমোদন পায়নি। অর্থ মন্ত্রনালয়ও এসব প্রকল্পে টাকা দিতে সায় দেয়নি। এমনকি এ নিয়ে বিভিন্ন দাতা গোষ্ঠির সঙ্গে দেন দরবার করলেও কোন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে প্রতিবেদনটি।
ঠিক কী প্রকল্প অনুমোদন পায়নি তা বিস্তারিতভাবে প্রতিবেদনে আসেনি। এ বিষয়ে খুঁজতে খুঁজতে চোখে পড়লো গতবছরের ৮ সেপ্টেম্বরের পত্রিকা। ৮ সেপ্টেম্বর অন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস বলে পত্রিকাগুলো এ বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করে থাকে। দৈনিক প্রথম আলো ‘নিরক্ষরতা দূর করতে তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর তরফে বলেছে, ব্যুরো নিরক্ষরতা দূরীকরণে দুটি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। মৌলিক সাক্ষরতা ও অব্যাহত শিক্ষা নামে দুটি প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প এক হলো ৬১ টি জেলার মানুষকে সাক্ষরকরণ, যার ব্যয় দুই হাজার কোটি টাকা। আর অন্যটি শুধু পার্বত্য তিনটি জেলার জন্য , ব্যয় পঞ্চাশ কোটিরও কিছুরও বেশি। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো আশা করেছে, এ বছরের জানুয়ারির অর্থনৈতিক কমিটির নির্বাহী পরিষদের (একনেকের) বৈঠকে অনুমোদন পাবে। জানুয়ারি হতে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করার কথা, জুন হতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করবে।

এখন সমকালের এ প্রতিবেদনটি বলা চলে সে প্রতিবেদনের আপডেট, পত্রিকার ভাষায় বললে ‘ফলোআপ’- অর্থাৎ জানুয়ারির একনেকে প্রকল্প দুটি অনুমোদন পায়নি। স্বাভাবিকভাবেই ব্যুরো প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারেনি। ফলে এ নিরক্ষরতা কার্যক্রম অনিশ্চয়তার মুখে পড়লো।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, আরো দেড় বছর আগে, গত সাক্ষরতা দিবসের আগের দিবসে ৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯ এ ও দুটি প্রকল্পের কথা বলা আছে। সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে সংবাদপত্রগুলোতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয় পুরো পৃষ্ঠার একটা বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। ২০০৯ এর এ ক্রোড়পত্রে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালকের প্রবন্ধে এ দুটি প্রকল্পের কথা স্পষ্টভাবে এসেছে। এর অর্থহলো অনেকদিন ধরেই প্রকল্প দুটি ঝুলে আছে।
আরেকটা বিষয় হলো, বর্তমান সরকার ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরতামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করলেও তাদের গত হওয়া দুই বছরে এ পর্যন্ত তারা কোন প্রকল্প হাতে নিতে পারেনি।
মজার বিষয় হলো, ২০১৫ সালের মধ্যে শিক্ষাসহ অনেক ক্ষেত্রেই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এমডিজি অর্জনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ। যার অংশ হিসেবে তার একবছর আগেই ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরতামুক্ত বা শতভাগ সাক্ষরতা নিশ্চিত করার কথা বলেছে সরকার। ভাবখানা এমন, এ আর তেমন কী, ২০১৫ লাগবে কেন, তার আগেই তো আমরা পারবো। বাস্তবতা হলো দেড় বছরের পরিকল্পনা এখনও পরিকল্পনায়ই আছে, আলোর মুখ দেখেনি।

বিশ্বের অনেক দেশ আছে যাদের সাক্ষরতার হার শতভাগ। এ তালিকায় শীর্ষের দেশগুলো হলো- জর্জিয়া, কিউবা, এস্টোনিয়া, পোল্যান্ড, বার্বাডোজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাক্ষরতার হার ৯৯ ভাগ।

অস্বীকার করার জো নেই, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন অত্যন্ত কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ বিষয়। চার বছরে তা অসম্ভব। এর জন্য আগে প্রাথমিক শিক্ষার দিকে দৃষ্টি দেয়া জরুরি। প্রাথমিক শিক্ষায় বর্তমান ভর্তির হার নব্বই ভাগের উপরে, এটা সন্তোষজনক। উদ্বেগটা ঝওে পড়ায়। এখনও পঞ্চম শ্রেণী হতেই প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ঝরে যায়। ঝরে পড়া বন্ধ করতে না পারলে শতভাগ সাক্ষরতা অকল্পনীয়।
আরেকটা হলো, বয়স্ক শিক্ষা। ১৫ হতে ৪৫ বছর বয়সীদের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষায় সাক্ষর করার কাজ চলছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর প্রকল্প ছাড়াও এনজিও গুলো কাজ করছে।
সাক্ষরতা অর্জনে শিক্ষানীতিও কয়েকটি ভূমিকার কথা বলেছে, জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি করে সকল শিক্ষিতদের অংশগ্রহণ, স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গড়ে তোলা এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্তকরণ।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাক্ষরতার কাজে লাগানো একটা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হতে পারে। উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সামার ভ্যাকেশনে তিন মাস বন্ধ দেয়া হয়। আমাদের দেশেও পরীক্ষা মূলকভাবে সকল বিশ্ববিদ্যালয় এরকম গ্রীষ্মের ছুটিতে তিন মাস বন্ধ দিয়ে, শিক্ষার্থীদের এলাকা ভিত্তিক সাক্ষর কার্যক্রমে লাগানো যেতে পারে। শ্রীলংকাও এটা করেছে, সেখানে সাক্ষরতার হার ৯২ ভাগ।

সরকারি বেসরকারি প্রচেষ্টা, স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বিশেষে সকলের সহযোগিতায়ই নিরক্ষরতামুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। শুধু শুধু শতভাগ সাক্ষরতার প্রতিশ্র“তি দিয়ে বসে থাকলে, ২০১৪’র স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।

Daily Samakal 23-02-2011

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।