Mahfuzur Rahman Manik
প্রাথমিক শিক্ষার পুনর্বিন্যাস (যায়যায়িদন ১৪ এিপ্রল ২০১০)
এপ্রিল 17, 2010

প্রাথমিক শিক্ষার পুনর্বিন্যাস
বিগত নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের ইশতিহারে শিক্ষা বিষয়টি আসে গুরুত্বের সঙ্গে। ইশতিহারে শিক্ষার প্রথম দু/তিনটি লাইন-মানব সম্পদ উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে যুগোপযোগী নতুন শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করা হবে। ইশতিহারের ওয়াদা অনুযায়ী ক্ষমতা গ্রহণ করেই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কাজে হাত দেয় সরকার। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে সভাপতি করে ১৮ সদস্যের শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হয়। কমিটির প্রথম সভা হয় ৩ মে ২০০৯; ১৯৭৪ সালের কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন এবং; ১৯৯৭ সালের শামসুল হক শিক্ষা কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে এ কমিটি একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। ২ সেপ্টেম্বর এর কাজ শেষ হয়। ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কাছে খসড়া শিক্ষানীতি জমা দেয়া হয়।
মাহফুজুর রহমান মানিক

এ শিক্ষানীতির প্রধান দিক হলো কাঠামোর পরিবর্তন। উচ্চ মাধ্যমিককে বাদ দিয়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এ তিন স্তরে শিক্ষাকে সাজানো হয়। অবশ্য এর বাইরে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থাও এখানে রয়েছে। সেটা প্রাথমিক শিক্ষার আগের স্তর। প্রাথমিক শিক্ষা প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা নবম, দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণী। এর পরের স্তর উচ্চ শিক্ষা।
এবারের শিক্ষানীতির আলোকে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আমার এ সামনের প্রয়াস। খসড়া শিক্ষানীতির ২৯টি অধ্যায়ের মধ্যে দ্বিতীয় অধ্যায়টি প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে। শিক্ষানীতির মোট ৯৬ পৃষ্ঠার মধ্যে ৯-১৬ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাটি কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনেও ছিল। সেখানে এর বাস্তবায়নের জন্য শিশু ভবন ও শিশু উদ্যান নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। শিশু ভবন জন্ম থেকে ৩ বছর পর্যন্ত শিশুদের জন্য এবং শিশু উদ্যান ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত শিশুদের জন্য।
এবারের শিক্ষানীতিতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাটি দেখানো হয়েছে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মানসিক ও দৈহিক প্রস্তুতি হিসেবে। যেখানে ৫+ বয়সী শিশুরা ভর্তি হবে। থাকবে আকর্ষণীয় উপকরণ আর শিশুর মনের বিকাশের যাবতীয় ব্যবস্থা। সঙ্গে সঙ্গে নিজ ধর্মের ধর্মীয় উপাসনালয়ে ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়টিও এসেছে।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শহরে চালু করা যতো সহজ হবে গ্রামের ক্ষেত্রে ততোটা সহজ হবে না। শহরে বিদ্যমান প্রাইভেট স্কুলগুলোয় প্রথম শ্রেণীর আগেই তিনটি শ্রেণী রয়েছে। প্লে, নার্সারি, কেজি ইত্যাদি নামে রয়েছে। এখানে আড়াই থেকে ৩ বছর বয়সী শিশুরা স্কুলে যায়।
শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে বলা হয়েছে সব শিক্ষার ভিত্তি। জাতীয় জীবনে এর গুরুত্ব অত্যধিক। এটি হবে সর্বজনীন বাধ্যতামূলক এবং অবৈতনিক। এ স্তরের দায়িত্ব সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের। সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদটি প্রণিধানযোগ্য-
রাষ্ট্র
ক. একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য,
খ. সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার
উদ্দেশে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য,
গ. আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য,
কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।
সংবিধানের এ বিধানের আলোকে প্রাথমিক শিক্ষাকে এ শিক্ষানীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয়েছে। বিদ্যমান বিভিন্ন ধারার মধ্যে একটি সুসমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়। শিক্ষানীতি প্রবর্তনের সময় বা এর আগে একমুখী শিক্ষার যে তোড়জোড় শোনা গিয়েছিল, সে গর্জনের বর্ষণটা সেভাবে হয়নি। শিক্ষানীতিতে মাদ্রাসার কথা এলেও ইংরেজি মাধ্যমের প্রতিষ্ঠানের কথা আসেনি।
২০১১-২০১২ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় ১০০ ভাগ শিক্ষার্থী ভর্তির কথা বলা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার স্তরকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাড়ানোর বিষয়টি যেমন আন্তর্জাতিক শিক্ষার সঙ্গে মিল রয়েছে, তেমনি প্রাথমিক শিক্ষার পর কেউ না পড়লেও যাতে কিছু করে খেতে পারে সে ব্যবস্থাও রয়েছে। এজন্য প্রাথমিকের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিষয়টি এসেছে।
শিক্ষক শিক্ষার্থীর একটি সুষম অনুপাতের কথা বলেছে। ১ঃ৩০। ঝরে পড়া রোধে চমৎকার কিছু সুপারিশ রয়েছে এ নীতিতে। শিক্ষার্থী উপবৃত্তি, দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা, স্কুল পরিবেশকে আনন্দদায়ক করে তোলা ইত্যাদি। আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ও বঞ্চিত শিশুদের কথাও বাদ পড়েনি।

শিক্ষণ পদ্ধতি ও পরীক্ষা পদ্ধতিতে শিশু উপযোগী চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে। আমাদের শহরের শিশুরা যেখানে জন্মের পর থেকেই পরীক্ষার জ্বরে আক্রান্ত, সেখানে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল। এবং প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে বিদ্যমান কাঠামোগত পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিলের সুপারিশ শিশুবান্ধব শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করবে।
শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে এইচইসসি/মাধ্যমিক পাস। শিক্ষানীতিতে উল্লিখিত শব্দ এইচইসসি দ্বারা কি বোঝানো হয়েছে? যদি শব্দটি এসএসসি ধরি তাহলে তার সঙ্গে যুক্ত মাধ্যমিক কথাটি বিদ্যমান শিক্ষা স্তর অনুযায়ী ঠিক আছে। তবে এ যোগ্যতা কিছুটা কম বলেই আমার কাছে মনে হয়। অবশ্য যদি এইচএসসি ধরি তার সঙ্গে মাধ্যমিক কথাটি প্রস্তাবিত শিক্ষা স্তর অনুযায়ী ঠিক আছে।
এতে অনেকের বক্তব্য এ নীতি বাস্তবায়ন হলে প্রাথমিক শিক্ষকরা চাকরি হারাবেন তা ঠিক নয়। কারণ তারা শুধু আগের মতোই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াবেন। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে।
প্রাথমিক শিক্ষার যা কিছু প্রয়োজন সব সুপারিশ এ নীতিতে রয়েছে। নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরির সম্ভাব্য খরচও দেখানো হয়েছে। এখন বাকি এটি চূড়ান্ত করা আর বাস্তবায়ন। এক্ষেত্রে জনগণ বা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের মতামতকে গ্রহণ করে এটি চূড়ান্ত করা দরকার। বাস্তবায়নের রোডম্যাপ ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। এতো লম্বা সময়ের কোনো অবকাশ নেই। যতো দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়নের কাজে হাত দেয়া উচিত। বিগত প্রতিবেদনগুলোর মতো হিমাগারে এটি যাবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।
প্রাথমিক শিক্ষা সরকারের চ্যালেঞ্জ। দেশের সার্বিক শিক্ষা এ সত্যর ওপরই নির্ভর করে। এ চ্যালেঞ্জের উপরই নির্ভর করে সামনের দিনের সফলতা আর ব্যর্থতা। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন এ শিক্ষার দ্বারাই বাস্তবায়ন হবে। এ শিক্ষানীতি সে পথেই নিয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।