Mahfuzur Rahman Manik
জলবায়ুর পরিবর্তন আমাদের করণীয়
মার্চ 25, 2010


উত্তপ্ত হচ্ছে পৃথিবী। পরিবর্তিত হচ্ছে জলবায়ু। পৃথিবীর এ উষ্ণতার প্রধান কারণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন। কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, সিএফসি-১২ প্রভৃতির গ্যাস অধিক পরিমাণে নির্গমনের ফলেই বাড়ছে এ উষ্ণতা। ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে। গরম হচ্ছে সমুদ্রের পানি। এক্ষেত্রে ইন্টার গভর্নরমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেন্ট চেঞ্জ তথা আইপিসিসির প্রতিবেদন প্রতিধানযোগ্য। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে আইপিসিসির তিনটি ওয়ার: M‡elK্কিং গ্রুপ তাদের প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্ত সার প্রকাশ করেছে। ওয়ার্কিং গ্রুপ-১ এর পর্যালোচনা অনুযায়ী, ১৭৫০ এরপর থেকে মানুষের নানাবিধ কর্মকা-ের ফলে বায়ুম-লে কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রো অক্সাইডসহ বহু তাপ শোষণকারী গ্যাসের ঘনত্ব ক্রমে বেড়েছে। ফলে ২০২০ দশকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়বে ০.৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওয়ার্কিং গ্রুপ-২ বলছে, উষ্ণতা বৃদ্ধির যে হার ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে তা বিশ্বকে নিয়ে চলেছে ভয়াবহ পরিণতির দিকে। আইপিসিসি আরো জানিয়েছে, ১৭৫০ সালের আগের সাড়ে ছয় লাখ বছরে বায়ুম-লে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ ছিল ১৮০ থেকে ৩০০ পিপিএম, ২০০৫ সালে তা হয়েছে ৩৭৯ পিপিএম, মিথেন ছিল ৩২০ থেকে ৭৯০ পিপিবি, ২০০৫ সালে তা হয়েছে ১৭৭৪ পিপিবি, নাইট্রাস অক্সাইড ছিল ২৭০ পিপিবি, ২০০৫ এ হয়েছে ২১৯ পিপিবি (পার পার্টস বিলিয়ন)। ফলে এভাবে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলে যা হবে তা হলো-গড় তাপ, তাপদাহ ও তীব্র বৃষ্টিপাত বাড়বে অধিক হারে। খরা টাইফুন ও হ্যারিকেনসহ মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপকতা এবং উঁচু জোয়ারের প্রচ-তা বাড়বে তীব্রভাবে। আর্কটিক ও এন্টার্কটিকার বরফ দ্রুত কমে আসবে ও গ্রীষ্মকালে তা বিলোপ পাবে। এর জন্য দায়ী কারা? দায়ী উন্নত বিশ্ব। বিশ্বব্যাংক ক্লাইমেট ডাটাবেজ ২০০৪ থেকে জানা যায়, ২০০২ সালে একজন আমেরিকান গড়ে ২০ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন করেছে। অস্ট্র্রেলিয়ায় এর পরিমাণ ১৬ টন, যুক্তরাজ্যে ৯ টন এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ৮ টন। উন্নত বিশ্বের বিলাসিতা আর শিল্পায়নই এর জন্য দায়ী। ১৯৯২ সাল থেকে ২০০৩ পর্যন্ত কার্বন গ্যাস নির্গমনে বিভিন্ন দেশের দায়ভার এবং জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচিতে তাদের অবস্থানের ভিত্তিতে ধনী দেশের ব্যয় সক্ষমতার মাত্রা নির্ধারণ করে অক্সফাম দাবি করেছে যে, গরিব দেশগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজন ব্যয়ের শতকরা ৪৪ ভাগ বহন করতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে, শতকরা ১৩ ভাগ বহন করতে হবে জাপানকে, ৭ ভাগের কিছু বেশি বহন করতে হবে জার্মানিকে, ৫ ভাগের কিছু বেশি বহন করতে হবে যুক্তরাজ্যকে, শতকরা ৪-৫ ভাগের কিছু বেশি বহন করতে হবে ইতালি, ফ্রান্স ও কানাডাকে এবং শতকরা ৩ ভাগ বহন করতে হবে স্পেন, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়াকে। উন্নয়নশীল এ বিশ্ব শিল্পায়নের নামে অধিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে নিজেরা উন্নত হয়েছে। কিন্তু ক্ষতি করেছে উন্নয়নশীল এবং দারিদ্র্য বিশ্বকে। উন্নয়নশীল বিশ্ব আজ মারাত্মক ক্ষতিতে রয়েছে। যার প্রকৃষ্ট মডেল বাংলাদেশ। তাই এ জলবায়ুর পরিবর্তনের যেমন দায়ী উন্নত বিশ্ব ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলায় সব দায় উন্নত বিশ্বের ঘাড়েই। কোনো প্রকার অপরাধ না করেই উন্নয়নশীল বিশ্ব যে ক্ষতির শিকার হয়েছে তার মোকাবেলায় উন্নত বিশ্বের দুটি প্রধান দায়িত্ব। প্রথমটি হচ্ছে যে ক্ষতি আমাদের হয়েছে তার ক্ষতি পূরণ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধকরণ। তাই এখানে ন্যায্যতার প্রশ্ন। জলবায়ু পরিবর্তনে যাদের কোনো ভূমিকা নেই সেসব ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জনগণের প্রতি ন্যায়বিচারের স্বার্থে উন্নত দেশগুলোরই উচিত প্রয়োজনীয় ব্যয় বহন করা। কিন্তু এ ব্যাপারে উন্নত বিশ্বের আচরণ খুবই দুঃখজনক। ইউএনএফসিসির চুক্তিমতে আমরা তিন ধরনের দেশপাই ঘী১ ভুক্ত দেশ। যারা উন্নত। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ দায়ী। তাদের কাজ হলো ক্ষতিপূরণ দেয়া। ঘী২ ভুক্ত দেশ যারা উন্নত কিন্তু খুব বেশি দায়ী নয় এরাও পরোক্ষভাবে দায়ী। ক্ষতিপূরণ দেয়ার দলেই। আর শেষ হলো ঘী৩ ভুক্ত দেশ। যারা ভুক্তভোগী তাদের ক্ষতিপূরণ দেবে। যেমন বাংলাদেশ। টঘঋঈঈ স্বাক্ষরিত দেশগুলোর বৈঠক অর্থাৎ ঈড়ঢ় এর বৈঠকের মাধ্যমে এগুলো স্বীকৃত। এ ব্যাপারে ঈড়ঢ় আর্টিকেল ৮-এর ৯-এ অর্থায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে সহায়তা দেয়ার কথা বলা হয়েছে।

এসবই ছিল চুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাস্তবে সবচেয়ে দায়ী আমেরিকাসহ অন্য উন্নত দেশগুলোর অনেকে বের হয়ে গেছে কিয়োটো প্রটোকল থেকে, ফলে অকার্যকর হয়ে গেছে এ চুক্তি। উন্নত বিশ্বের আগের আচরণ ছিল বৈষম্যমূলক। যেখানে তারা জলবায়ুর পরিবর্তনে দায়ী করছিল উন্নয়নশীল বিশ্বকেই। বলেছেÑ তোমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এর জন্যই এ জলবায়ুর পরিবর্তন। সবচেয়ে চমকপ্রদ এক তথ্য দিয়েছেন আল গোর। তার বইয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ দায় এড়াতে যে গোপন কৌশল করেছে তা ফাঁস করেছেন। বইয়ের ৪২ নং পৃষ্ঠার (বাংলা অনুবাদ) কিয়দংশ হুবহু তুলে ধরছি- ‘১৯৯০ সালের ধরিত্রী দিবসের প্রাক্কালে বুশ প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত হোয়াইট হাউস নীতিবিষয়ক মুখপাত্র কর্মকর্তাদের কাছে একটা গোপন স্মারক পাঠায়। যাতে আভাস দিয়ে বলা হয় যে, বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে কার্য ব্যবস্থায় জনগণকে তাদের সমর্থন না দেয়ার ব্যাপারে বোঝানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হবে। এ ধরনের সমস্যার আদৌ অস্তিত্ব নেই এ কথা সরাসরি না বলে এ ব্যাপারে অনেক অনিশ্চিত বিষয় রয়েছে এ রকম বক্তব্য তুলে ধরা। বলা বাহুল্য, হোয়াইট হাউজের এ স্মারকটি সংবাদপত্রে ফাঁস হয়ে যায়। কাজেই হোয়াইট হাউজ দিয়ে গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার মোকাবেলা যে প্রতিশ্রুতি বুশ করেছিলেন তার স্বরূপ এরকমই।’অবশ্য আজকের ধনী দেশগুলোর টনক নড়েছে। মার্কিন প্রশাসনেও বারাক ওবামার নেতৃত্ব বিশ্ববাসীর পক্ষেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের ন্যায্যতা আদায়ে সোচ্চার। মালদ্বীপ যেমন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে তেমনি বাংলাদেশের ভূমিকাও কম নয়। প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘের বক্তব্যে ভূয়সী প্রশংসা করেছে বারাক ওবামাসহ বিশ্ব নেতারা। আজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন এগিয়ে আসছে সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নেতারাও ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। জলবায়ুর পরিবর্তনে সবার দায়িত্ব পালনে সবাই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দৃষ্টি এখন ডিসেম্বরের কোপেনহেগেন। জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলায় দায় দিতে প্রস্তুত উন্নত বিশ্ব। তার ফলে বলা চলে গোটা বিশ্ব এ ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ। তাই সম্প্রতি জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন দ্যা নিউইয়র্ক টাইমসে এক নিবন্ধে ‘আমরাই পারি’ শিরোনামে লিখেছেন ‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সারাবিশ্বের নেতাদের যুক্ততা ও নেতৃত্ব দিন দিন বাড়ছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জাতিসংঘ সদর দপ্তরে শতাধিক দেশের জলবায়ুর পরিবর্তন সম্মেলনে যোগ দেন। তার এ অংশগ্রহণ সংহতি ও দায়বদ্ধতা স্পষ্ট বার্তাবাহী। একইভাবে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নেতারা দূষণমুক্ত জ্বালানি প্রযুক্তির উন্নতি ঘটানো ও কোপেহেগেন সম্মেলন সফল হওয়া নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নরওয়ে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত নির্গমন কমাতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন। বন ধ্বংসের ফলে যে নির্গমন তা প্রচুর পরিমাণে কমানোর পরিকল্পনা হাজির করেছে ব্রাজিল । নির্গমন কমাতে ভারতও নানা কার্যক্রম নিচ্ছে। বান কি মুন তার নিবন্ধে আরো উল্লেখ করেছে- ধীরে ধীরে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোপেনহেগেন সম্মেলনের কাছাকাছি চলে এসেছি। আর সে সম্মেলনের সফলতার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। সম্প্রতি লন্ডনে অথনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী ১৭টি দেশের (যারা বিশ্বের ৮০ ভাগ কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী) এর সভায় বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন জানিয়েছেন, দেশগুলো এতে সম্পৃক্ত হয়ে পরিবর্তনের কোনো সমন্বিত এজেন্ডা তুলে ধরলে কোপেনহেগেন সম্মেলনের সফলতা দূরবর্তী কোনো জিনিস হবে না।’উন্নত বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তাদের দায় দিতে প্রস্তুত। সেটি যতো উপায়ে সম্ভব তা করবে। এর পাশাপাশি আমাদেরও অনেক করণীয় রয়েছে। আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ জলবায়ুর অভিঘাতে বিপর্যস্ত। আমাদের প্রাণের দেশকে রক্ষা করতে হবে আমাদেরই। জলবায়ুর পরিবর্তনে আমরা কোনোভাবেই দায়ী নই। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের তালিকায় আমাদের অবস্থান বিশ্ব র‌্যাকিংয়ে ১৮২তম। অথচ যে গ্রিনহাউসের নির্গমনের কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে, বিশ্ব উষ্ণতা বাড়ছে তার অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মডেল বাংলাদেশ। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্তদের বিশ্ব র‌্যাকিংয়ের চ্যাম্পিয়নশিপটি বাংলাদেশের হাতে। ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি ফর ডিজাস্টার রিডাকশনের মতে খাদ্য ঝুঁকিতে বাংলাদেশের স্থান প্রথম। আবার ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সের (জলবায়ু ঝুঁকিসূচক) তালিকায় প্রথম নামটি বাংলাদেশের। বাস্তবতাও তাই বলে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর প্রাকৃতিক দুর্যোগÑ বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় তারই লক্ষণ মাত্র। ২০০৭-এর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর। এরপর বন্যা, আবার আইলা ইত্যাদিতে লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্লাইমেট চেঞ্জ সেলের তথ্য মতে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৯৩টি বড় বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে, ফলে প্রায় দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে ক্ষতি হয়েছে ৫.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্ষার সময় বৃষ্টি না হওয়া, সমুদ্রে ঘনঘন বিপদ সঙ্কেত এসবই জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলেই হচ্ছে। এসব দুর্যোগ যেমন জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে হচ্ছে পাশাপাশি আরো কিছু বাস্তব কারণও রয়েছে। ভৌগোলিকভাবে আমাদের অবস্থানই এ ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর আর উত্তরে হিমালয়। আমাদের জনসংখ্যার ঘনত্ব আর জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি জলবায়ুর পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে। আমাদের সামাজিক অবস্থান আর অর্থনৈতিক অবস্থাও এর জন্য কম দায়ী নয়। এসব অবস্থা বিদ্যামান থাকতে জলবায়ুর পরিবর্তন বর্তমানের মতো এতো দ্রুত হতে থাকলে আমাদের অস্তিত্ব বাঁচানোই দায়। বিজ্ঞানীদের ধারণা বাংলাদেশ আগামী কয়েক দশকের মধ্যে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং ৪৫ সেন্টিমিটার বা তার বেশি সমুদ্র স্ফীতির মুখোমুখি হতে পারে। ফলে স্থায়ীভাবে প্লাবিত হতে যাওয়া ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে দেশের ব্যাপক উপকূলীয় এলাকা ও অন্যান্য নিম্নাঞ্চলে বসবাস এবং অর্থনৈতিক কর্মকা-ের জন্য উপযুক্ততা হারাবে। এসব এলাকার মানুষ যে শুধু আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের কবলে পড়বে তাই নয় বরং তাদের মধ্যে অসংখ্যজন উদ্বাস্তুর কাতারে যোগদান করতে বাধ্য হবে। বিধ্বংসী বন্যার প্রকোপ বাড়লে বাড়িঘর, মাঠের ফসল, ছোট ছোট শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, টেলিযোগাযোগ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পুনর্বাসন ব্যবস্থাও ব্যাহত হবে। বন্যার ফলে দেখা দেবে নানা রোগ। দরিদ্র হবে হতদরিদ্র। জলবায়ুর পরিবর্তনে জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ব্যাপকভাবে বিনষ্ট হবে। খাদ্য নিরাপত্তা ব্যাহত হবে। কৃষি ফসলের জমি কমবে, সমুদ্রে পানির উচ্চতা বেড়ে তলিয়ে যেতে পারে আমাদের স্বদেশ। জলবায়ুর পরিবর্তনে বাংলাদেশের প্রধান প্রভাব পড়বে পানি সম্পদ, উপকূলীয় অঞ্চল, কৃষি, স্বাস্থ্য, জীবনধারা, খাদ্য, বাসস্থানের ওপর। আমরা যখন এসব হতাশাচ্ছন্ন প্রতিবেদন দেখছি পাশাপাশি আমাদের আশার আলোও আছে। আশার আলোর প্রদীপটিকে প্রজ্বলিত করতে সেটি চারদিকে আলোকিত করতে আমাদের করণীয় অনেক। করণীয়র পথে আমরা ইতিমধ্যে হাঁটতে শুরু করেছি। এ পথের বাকি আরো অনেক। প্রথমত, জলবায়ুর পরিবর্তনে আমরা যে দায়ী নই আর যারা দায়ী তাদের কাছে আমাদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সাহসের সঙ্গেই তুলে ধরতে পেরেছি। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় আমাদের সরকারের সে তৎপরতায় বিশ্ব বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। আমাদের এ ক্ষতির মোকাবেলা সার্বিক ব্যবস্থাপনায় যে গবেষণা প্রয়োজন তার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরে ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ক্লাইমেট চেঞ্জ সেল। আর সবচেয়ে বড় বিষয়টি অ্যাডাপটেশন তথা অভিযোজন। এর জন্য যে অর্থায়ন প্রয়োজন তার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। ২০০৭-এর বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়ের পর সে বছরের ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত জলবায়ুর পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘ সম্মেলনে বাংলাদেশ বিশ্বের মনযোগ আকর্ষণ করে এবং ধনী দেশের সহযোগিতার দাবিতে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য সরকারের আগ্রহে ২০০৮ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ ইউকে কনফারেন্স অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ এ সম্মেলন থেকে বাংলাদেশ আবারো উন্নত বিশ্বের প্রতি জোরালোভাবে আহ্বান জানায় গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর জন্য এবং বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অভিযোজনের ব্যয় বহনের জন্য। সে দিন বিশ্বব্যাংক, এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক বাংলাদেশকে সহযোগিতার দৃঢ় আশ্বাস দেন। ডাচ রাষ্ট্রদূত বলেন, আমরা নিশ্চয়তা দিতে চাই যে, বাংলাদেশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে না। সে দিন সবাই মিলে বলেন, তারা বাংলাদেশের জন্য একটি ‘মাল্টি ডোনার ট্রাস্ট ফান্ড’ প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছেন। বাংলাদেশ ও ক্লাইমেট চেঞ্জ ফান্ড নামে ২০০৯-এ একটি ফান্ড তৈরি করেছে। অ্যাডাপটেশনের জন্য প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সম্মেলনে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন। উন্নত বিশ্ব আমাদের ক্ষতিপূরণ দিলে সেটি যাতে যথার্থ কাজে লাগানো যায় এর নিশ্চয়তার দরকার সবচেয়ে বেশি। আমাদের প্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ, মেরামত, উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ইত্যাদির কাজ সুন্দরভাবে করতে হবে। কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। এর সঙ্গে জড়িত একদিকে ৭০ ভাগ মানুষের পেশা কৃষি, অন্যদিকে ১০০ ভাগ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা। ফলে এ খাতের গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন সবার আগে। এ ছাড়াও সচেতনতা আমাদের অন্যতম করণীয়। সেটা হতে পারে কোনো ঝড়ের সময়ে শেল্টারে আশ্রয় গ্রহণ। কিংবা সাগরে মাছ ধরতে গেলে কোনো বিপদের আভাস পেলে সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসা, বন না কাটা। বেশি বেশি গাছ লাগানো ইত্যাদি। গ্রিনহাউস গ্যাস আমরা যতোটুকু নির্গমন করি তা জলবায়ু পরিবর্তনে তেমন কোনো ভূমিকা না রাখলেও এটি নিঃসরণ আমাদের দ্বারা যেন না হয়। কিংবা যতোটা সম্ভব কমিয়ে আনা। আমাদের ঘর-বাড়ি, টিউবওয়েল লেট্রিন ইত্যাদি অনেক উঁচু করে নির্মাণ করা। যে কোনো দুর্যোগে একদল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক সবসময় রাখা। কৃষক-শ্রমিক-চাকরিজীবী ব্যবসায়ী তথা সর্বস্তরের মানুষের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাকরণ। সমাজের অতিদরিদ্রদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ। যে কোনো উন্নয়ন কর্মকা-ে যেন জলবায়ুবিষয়ক বাড়তি ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকে। জলবায়ুর পরিবর্তনের অভিঘাত এলাকাভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। সেক্ষেত্রে এটি মোকবেলায় এলাকাভিত্তিক বা সময়ভিত্তিক প্রয়োজনীয় কর্মসূচি নেয়া যেতে পারে। সর্বোপরি আজকের পৃথিবীতে কৃষি উন্নয়ন আর শিল্প উন্নয়নকে ছাপিয়ে আরেকটি উন্নয়নের কথা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। মানব সম্পদ উন্নয়নে ঐঁসধহ জবংড়ঁৎপব ফবাবষড়ঢ়সবহঃ আমরা যদি প্রত্যেকটি নাগরিককে মানব বোঝা মানব সম্পদে পরিণত করতে পারি তবে দেশের সব সমস্যা উত্তরণ সম্ভব। আর জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এ মানব সম্পদ দ্বারাই সহজে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। অবশ্য দেশের তরুণ সমাজেরও এখানে ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে আর আমাদের দেশে সবকিছুর আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। জলবায়ু পরির্বতন ইস্যুটি শুধু বাংলাদেশের সঙ্কটই নয় বিশ্ব সঙ্কটও বটে। বিশ্বের এ বার্নিং ইস্যুর মোকাবেলায় উন্নত বিশ্বই যথেষ্ট। আমরাও আমাদের করণীয় পালন করবো। আশা করছি কোপেনহেগেন ডিসেম্বরের (৭-১৮) সেদিনের জন্যই অপেক্ষা করছে যেদিন উন্নত বিশ্ব বলবে আমাদের প্রাণের এ পৃথিবীকে আমরা ধ্বংস করবো না। বাসযোগ্য পৃথিবীতে সবাই শান্তিতেই বাস করবে। আমাদের অপরাধের কারণে নিরীহ মানুষদের শাস্তি দেবো না। স্বপ্নের পৃথিবীর সত্যিকার রূপেই বাস্তবে ধরা দেবে। আর বাংলাদেশ বলবে আমরা এটাই চেয়েছি, আমাদের সবুজ-শ্যামল দেশটির সবুজ ধরে রাখতে আমরা প্রতিজ্ঞ।

যায়যায়দিনে প্রকাশিত ০৬ ডিসেম্বর ২০০৯

http://www.jaijaidin.com/details.php?nid=164058

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।