Mahfuzur Rahman Manik
ভাষার গৌরব বনাম নিরক্ষরতার লজ্জা
ফেব্রুয়ারী 27, 2022
নিরক্ষরতা মানুষের জীবনের প্রাত্যহিক জরুরি প্রয়োজন মেটানোর পথে বাধা হলেও সাক্ষরতা কার্যক্রম প্রকল্প ও দিবসে বন্দি হয়ে পড়েছে।

বিষয়টির চিন্তা আরও উস্কে দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমানের সাম্প্রতিক এক 'ফেসবুক স্ট্যাটাস'। আমার এ শিক্ষক যথার্থই লিখেছেন, 'বিস্ময়কর ও বেদনাদায়ক হলেও সত্য, যে জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সৃষ্টি করেছে, সে জাতির কোটি কোটি মানুষ পড়তে ও লিখতে পারে না!' এটা লজ্জারই বিষয়, যে বাংলা ভাষা আমাদের এত আবেগ-অনুভূতির জায়গা; দেশের অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষ সে বাংলার আবেদন অনুধাবন করতে পারছে না। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের ভাষিক যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ দুটি মাধ্যম- পড়া ও লেখার ক্ষেত্রে তারা বাংলা ব্যবহার করতে পারে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বিষয়টি নিয়ে সব পর্যায়ে যে ধরনের সক্রিয়তার প্রয়োজন ছিল, তাও নেই। বাস্তবতা হলো, নিরক্ষরতা মানুষের জীবনের প্রাত্যহিক জরুরি প্রয়োজন মেটানোর পথে বাধা হলেও সাক্ষরতা কার্যক্রম প্রকল্প ও দিবসে বন্দি হয়ে পড়েছে।
ভাষার মাসে সাক্ষরতার আলোচনা বইমেলার কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর বইমেলায় বাংলা ভাষায় যে হাজার হাজার বই প্রকাশ হয়; নিরক্ষর মানুষ সে বইয়ের অক্ষরগুলোর কাছে যেন অসহায়। বাংলার জ্ঞানভান্ডারের এত রস থেকে তারা বঞ্চিত। লেখকদের চিন্তার প্রতিফলন যে বইয়ের মাধ্যমে ঘটে; যে বইগুলো জাতিকে পথ প্রদর্শন করে; যে বই আলোর ইশারা দেয়- যারা পড়তে পারে না, সেগুলো তাদের জন্য যেন অন্ধকার। জাতি হিসেবে এ ব্যর্থতা আমাদেরই। দেশের অধিকাংশ নাগরিক যেখানে সাক্ষর; সেখানে একটি অংশ এতদিন ধরে আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আমাদেরই সদিচ্ছা এবং উদ্যোগের অভাবে! প্রতিদিন যে এত আয়োজন নিয়ে সংবাদপত্র প্রকাশ হয়; সাপ্তাহিক, মাসিক, ষাণ্মাসিক তথা মেয়াদভিত্তিক যে সাময়িকী প্রকাশ হয়; যারা পড়তে জানে না- এগুলো তাদের জন্য নিরর্থক কাগজ। এমনকি ফেসবুক বা মুখবইও তাদের পড়ার সুযোগ কই! বাস্তব জগতের বাইরে ভার্চুয়াল জগৎ যে মানুষের আরেকটি বিশাল জগৎ হয়ে পড়েছে; সেখানেও সবাই নিজ নিজ ভাব প্রকাশ করছে; নিরক্ষরতা তাদের সেখানে প্রবেশের পথেও সবচেয়ে বড় বাধা।
দেশে ঠিক কত কোটি মানুষ এখনও সাক্ষর নয়- তার হিসাব পেতেও আমাদের সাক্ষরতা দিবসের দিকে তাকাতে হয়। কারণ প্রশাসনের তরফ থেকে বলা চলে, ওই একটি দিনেই এ তথ্য জানানো হয়। গত বছর ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো প্রকাশিত ক্রোড়পত্রে আমরা দেখেছি, দেশে সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সে হিসাবে এখনও দেশে অন্তত ৪ কোটি মানুষ নিরক্ষর। বিস্ময়কর হলেও সত্য; ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঘোষণা ছিল- ২০১৪ সালের মধ্যে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করা হবে। ২০১০ সালে সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতির ঘোষণায়ও উল্লিখিত সময়ের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতা নিশ্চিতের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। তারও প্রায় ৮ বছর পার হতে চলল। এর পরও কেন দেশের উল্লেখযোগ্য অংশ সাক্ষরতার আলোহীন? দুঃখজনক হলেও সত্য, সময় পার হয়ে গেলেও অতিরিক্ত সময়ে সবার সাক্ষরতা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের যতটা তৎপর হওয়া উচিত ছিল, তা দেখছি না।
কেন আমরা ২০১৪ সালের মধ্যে শতভাগ সাক্ষরতা পূরণ করতে পারিনি কিংবা তার ধারে-কাছেও যেতে পারিনি; বিষয়টি নিয়ে জাতীয় ব্যর্থতারও পর্যালোচনা হয়নি। বিষয়টি আমি অনুসন্ধান করেছিলাম এবং সমকালে লিখেছিও। তখন মূলত দুটি বড় প্রকল্পের মাধ্যমে শতভাগ সাক্ষরতার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু অর্থের কারণ দেখিয়ে যথাসময়ে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যায়নি। এখনও সাক্ষরতা কার্যক্রম চলছে ঢিমেতালে। গত সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি হিসাবে এক বছরে দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছিল মাত্র দশমিক ৯ শতাংশ। এ হারে সাক্ষরতা বাড়তে থাকলে শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন করতে ২৭ বছর লেগে যাবে। অথচ সদিচ্ছা থাকলে এবং বিষয়টি অগ্রাধিকারে থাকলে অল্প সময়েই শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন অসম্ভব নয়।
বলাবাহুল্য, সরকারের অন্যান্য প্রকল্প থেমে নেই। উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা কেউই অস্বীকার করবে না। কিন্তু দেশের উল্লেখযোগ্য নাগরিক যদি লিখতে-পড়তেই না পারে; তারা কীভাবে এ উন্নয়নের সুফল উপলব্ধি করবে? আমার ব্যক্তিগত মত, শতভাগ মানুষকে সাক্ষর করা এখনকার সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। অন্যান্য মেগা প্রকল্পে যে খরচ হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে হয়তো এত অর্থেরও প্রয়োজন পড়বে না। সরকার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ২১ লাখ মানুষকে সাক্ষর করার ঘোষণা দিয়েছিল; তার হালনাগাদ তথ্য আমাদের জানা নেই। হয়তো সে তথ্য পেতে আবার সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এটা ঠিক, মাঝখানে করোনা দুর্যোগের প্রভাব পৃথিবীর অনেক কিছুতেই পড়েছে। এ কারণে সাক্ষরতা কার্যক্রমে ভাটা পড়ার অজুহাত হিসেবে করোনা প্রসঙ্গ আসতে পারে। কিন্তু যেখানে সব কার্যক্রম চলছে, সেখানে নিরক্ষরতা দূরীকরণ কার্যক্রম বন্ধ থাকবে কেন? বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনার কারণে সাক্ষরতার চ্যালেঞ্জ আরও বেড়েছে। বিশেষ করে আমরা জানি, এ সময়ে একটানা দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেকে ঝরে পড়েছে। তাদের পুনরায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় আনা কিংবা উপানুষ্ঠানিক উপায়ে শিক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বাংলা ভাষার সৌরভ আর গৌরব দেশের প্রত্যেক নাগরিক উপলব্ধি করুক। সবাইকে মাতৃভাষায় কথা বলার পাশাপাশি লেখা ও পড়ার সুযোগ করে দিতেই হবে। ৭০ বছর আগের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সার্থকতাও তখনই হবে যখন সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন হবে এবং সব মানুষ সব উপায়ে এ ভাষায় যোগাযোগ করতে পারবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের এ সময়ে মানুষ মহাকাশ জয় করছে, সমুদ্র জয় করছে। এক দল যখন বিশ্বজয়ে বিভোর, আরেক দল মানুষ তখন নিরক্ষরতার অন্ধকারে থাকবে- তা কী করে হয়! আমাদের সামনেই একজন মানুষ চোখ থাকতে 'অন্ধ' হবে- সেটি মেনে নেওয়া যায় না। বাংলা ভাষা সুরক্ষার অংশ হিসেবেই সবার সাক্ষরতা নিশ্চিত করা জরুরি।

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।